ছোটনাগপুর মালভূমির পূর্ব
সীমান্তে ঝাড়খণ্ডের দুমকা জেলায় মলুটি গ্রাম। সেখানেই রয়েছে দেবী
মৌলীক্ষার মন্দির। রামপুরহাট স্টেশন
থেকে যার দূরত্ব ১৭ কিলোমিটার। টোটোয় চেপে যেতে সময় লাগে প্রায় এক ঘণ্টা। টোটো
ভাড়া নেয় ১২০ টাকা। টোটোয় যাত্রাপথে রাস্তার দু’পাশে পড়বে ঘন মহুলবনের জঙ্গল। ১৭৯০ সালে এক ইংরেজ আধিকারিকের রিপোর্ট
অনুযায়ী, আগে এখানে বাঘ-ভাল্লুক ছাড়াও বুনো হাতির ব্যাপক
উপদ্রব ছিল। তার জেরে পার্শ্ববর্তী প্রায় ৫৬টি গ্রাম চিরতরে
জনশূন্য হয়ে গিয়েছিল। প্রচন্ড লড়াই করে রয়য়ে গিয়েছিল সাঁওতাল
অধ্যুষিত কিছু গ্রাম।
এগুলির মধ্যেই একটি হল পাতরাঙ্গা।
এই গ্রামের কাছেই রয়েছে আদিবাসীদের জাগ্রত সর্পদেবী নাগকাটির মন্দির।
মহুল গাছের জঙ্গল কেটে গ্রাম
গড়ে উঠেছিল বলেই গ্রামের নাম হয়েছে মহুলটি। সেখান থেকে অপভ্রংশ হয়ে হয় মলুটি। কেউ আবার বলেন দেবী মৌলীক্ষার নাম থেকেই এমন নামকরণ। ‘মৌ’
শব্দের অর্থ মস্তক বা মাথা। আর, ‘ঈক্ষা’
শব্দের অর্থ- দর্শন বা দেখা। কথিত আছে দেবী মৌলীক্ষার এই ধড়হীন
মূর্তির সাধনা করতেন বৌদ্ধ তান্ত্রিক বজ্রযোনি সম্প্রদায়।
মধ্যযুগে রাজা বসন্ত রায়ের
প্রতিষ্ঠিত নানকর বা করমুক্ত রাজ্য মলুটি গ্রামকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। রাজারা বাস করতেন গ্রামের মাঝখানে দোতলা মাটির বাড়িতে। তার
চারপাশে তাঁরা একের পর এক মন্দির তৈরি করেছেন। কাশীধামের সঙ্গে এই মন্দিরের খুব মিল ছিল তাই একে ‘গুপ্তকাশী’
বলা হয়। কথিত আছে, ১৬৯৫ খ্রিস্টাব্দ
নাগাদ এখানকার নানকর রাজপরিবারের সদস্যরা চারটি পরিবারে বিভক্ত হয়ে যায়। তারপরই
নিজেদের মধ্যে শুরু হয় মন্দির তৈরির প্রতিযোগিতা। মোট ১০৮টি শিবমন্দির গড়ে তুলেছিলেন। বর্তমানে অবশিষ্ট আছে শিব-দুর্গা-কালী-সহ বিভিন্ন দেবদেবীর ৭২টি
মন্দির। প্রতিটি মন্দিরের গায়ে রয়েছে টেরাকোটার অসাধারণ কাজ।
এখানেই রয়েছে দেবী মৌলীক্ষার মন্দির। মূল মন্দিরের আগে
রয়েছে বিরাট আকারের নাটমন্দির। তারপর কয়েক পা এগোলে দেবীর গর্ভগৃহ। দেবীর মূল
মন্দিরটি দেখতে অনেকটা তারাপীঠের মন্দিরের মত। বাংলার দোচালা স্থাপত্য রীতি মেনে
তৈরি। মন্দিরের বাঁদিকে আছে দুটো ষজ্ঞবেদী। মন্দিরের ডানদিকে পুরাতন স্থাপত্যের
নির্দশন হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক শিবমন্দির। যার শিবলিঙ্গটি বহু প্রাচীন। তার পাশে
রয়েছে বামাক্ষ্যাপার সাধনকক্ষ। কথিত আছে, বামাক্ষ্যাপা এখানে সাধনায়
সিদ্ধিলাভ করে তারপর তারাপীঠে গিয়েছিলেন। দেবী মৌলীক্ষার মন্দিরের পাশে রয়েছে
মানতবৃক্ষ। যেখানে ভক্তরা পাথরের টুকরো সুতোয় বেঁধে মানত করে যান। দেবী মৌলীক্ষার
গর্ভগৃহে মূর্তির পাশেই আছে এক প্রস্তরখণ্ড। যার অবয়ব অনেকটা ধ্যানমগ্ন মূর্তির
মত। ভক্তরা এই পাথরের খণ্ডকে কালভৈরব রূপে পুজো করেন।
ভক্তদের অনেকের দাবি, তারাপীঠে থাকাকালীন বামাক্ষ্যাপা প্রায়ই বলতেন মলুটির দেবী মৌলীক্ষা হলেন
দেবী তারার বড় বোন। আর, দেবী তারা হলেন দেবী মৌলীক্ষার ছোট
বোন। কথিত আছে, বিভিন্ন সময়ে বহু সাধক মলুটি গ্রামকে তাঁদের
সাধনার লীলাক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। আদি শংকরাচার্যও নাকি কাশী বা বারাণসী
যাওয়ার পথে মলুটি গ্রামে এসেছিলেন। এখান থেকেই নাকি তিনি বৌদ্ধ ধর্মবিরোধী হিন্দু
জাগরণ আন্দোলনের সূচনা করেন।