১৯৪৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ভারত ইতিহাসের সেই তারিখ যেদিন ভারতীয় সেনাবাহিনী অপারেশন পোলো চালিয়েছিল। এই অপারেশনের
সঙ্গে খেলাধুলার কোনো সম্পর্ক ছিল না, বরং এটি ছিল হায়দ্রাবাদে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একীভূতকরণের জন্য একটি সামরিক
পদক্ষেপ। ভারতের এই পদক্ষেপে ক্ষুব্ধ ছিল পাকিস্তান। তারা জাতিসংঘেও বিষয়টি
উত্থাপন করার চেষ্টা করলেও কোনও লাভ হয়নি। আয়তনের দিক থেকে, তখনকার হায়দরাবাদ রাজ্যটি ইংল্যান্ড এবং স্কটল্যান্ডের মোট
ভূখণ্ডের থেকেও অনেক বড় ছিল।
এমনকি ব্রিটিশ আমলেও হায়দরাবাদের
নিজস্ব সেনাবাহিনী, রেল পরিষেবা এবং ডাক
টেলিগ্রাফ বিভাগ ছিল। জনসংখ্যা এবং মোট জাতীয় উৎপাদনের দিক থেকে হায়দরাবাদ ছিল
ভারতের বৃহত্তম রাজকীয় প্রাসাদ। এলাকাটি ছিল ৮২৬৯৭ বর্গ মাইল। নিজাম প্রাণপণ
চেষ্টা করেছিলেন যে তাঁর রাজ্যকে কোনও অবস্থাতেই যেন ভারতের সঙ্গে অন্তর্ভূক্ত করা
না হয়। তিনি পাকিস্তানের কায়েদ-ই-আজম জিন্নাহকে বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়েছিলেন যে
তিনি যাতে হায়দরাবাদকে পকিস্তানে অন্তর্ভূক্তির ব্যবস্থা করেন। জিন্নাহ তাকে এ
ব্যাপারে পূর্ণ আশ্বাসও দিয়েছিলেন। এ ছাড়া আরও অনেক দেশের সঙ্গে নিজামের সম্পর্ক
ছিল। সবচেয়ে বড় কথা তুরস্কের শেষ খলিফার মেয়ের সাথে নিজামের বিয়ে হয়েছিল।
টাইম ম্যাগাজিন তাকে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হিসেবেও চিহ্নিত করেছে।
হায়দরাবাদের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ ছিল
হিন্দু,
মুসলমানরা ছিল সংখ্যালঘু। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রশাসন ও
সেনাবাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিল তারা। ইতিহাসবিদ কে এম মুন্সির বই
"এন্ড অফ অ্যান এরা" বলে যে নিজাম জিন্নাহকে একটি বার্তা পাঠিয়ে জানার
চেষ্টা করেছিলেন যে তিনি ভারতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হায়দরাবাদকে সমর্থন করবেন
কিনা।
প্রধানমন্ত্রী নেহেরু এবং
মাউন্টব্যাটেন পুরো বিষয়টি শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করার পক্ষে ছিলেন। সর্দার
প্যাটেল এতে রাজি হননি। তিনি বিশ্বাস করতেন যে সেই সময়ের হায়দরাবাদ 'ভারতের পেটে ক্যান্সারের মতো', যা সহ্য করা যায় না। প্যাটেলের ধারণা ছিল হায়দরাবাদ পুরোপুরি পাকিস্তানের
অঙ্গুলীহিলনে চলছে। এমনকি পাকিস্তান পর্তুগালের সঙ্গে হায়দ্রাবাদের চুক্তি করার
প্রাক পর্বেও ছিল, যার পরে তারা
গোয়াতে নিজের জন্য একটি বন্দর তৈরি করতে চেয়েছিল।
হায়দরাবাদের নিজামও কমনওয়েলথের
সদস্য হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, যা এটলি সরকার প্রত্যাখ্যান করেছিল। নিজামের সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল এল এডরুস
তার "হায়দরাবাদ অফ দ্য সেভেন লাভস" বইতে লিখেছেন যে নিজাম নিজেই তাকে
অস্ত্র কেনার জন্য ইউরোপে পাঠিয়েছিলেন।
এক সময় যখন নিজাম অনুভব করেছিলেন যে
ভারত হায়দ্রাবাদকে একীভূত করতে বদ্ধপরিকর, তখন তিনি হায়দরাবাদকে একটি স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য হিসাবে রেখে ভারতকে বৈদেশিক
বিষয়,
প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগের দায়িত্ব হস্তান্তর করার
প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। প্যাটেল হায়দরাবাদে সামরিক পদক্ষেপের পক্ষে ছিলেন। একই
সময়ে,
প্যাটেল জেনারেল কে এম কারিয়াপ্পাকে ডেকে জিজ্ঞাসা
করেছিলেন যদি হায়দরাবাদ ইস্যুতে পাকিস্তানের কাছ থেকে সামরিক প্রতিক্রিয়া আসে
তবে তিনি কি কোনও অতিরিক্ত সাহায্য ছাড়াই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারবেন? কারিয়াপ্পা এক কথায় উত্তর দিয়েছিলেন- হ্যাঁ।
এরপর সর্দার প্যাটেল হায়দরাবাদের
বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ চূড়ান্ত করেন। ভারতের তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল রবার্ট
বুচার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ছিলেন। তিনি বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী এর জবাবে আহমেদাবাদ বা বোম্বেতে বোমা ফেলতে পারে।
হায়দরাবাদে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রবেশের দু’বার তারিখ
নির্ধারণ করা হয়েছিল কিন্তু রাজনৈতিক চাপের কারণে তা বাতিল করতে হয়েছিল। নিজাম
গভর্নর জেনারেল রাজাগোপালাচারীর কাছে তা না করার জন্য ব্যক্তিগত অনুরোধ করেন।
এদিকে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময়
প্যাটেল গোপনে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে হায়দরাবাদে পাঠান। যখন নেহেরু এবং
রাজাগোপালাচারী ভারতীয় সেনাবাহিনী হায়দ্রাবাদে প্রবেশের খবর পান, তখন তারা চিন্তিত হয়ে পড়েন। প্যাটেল ঘোষণা করেন যে
ভারতীয় সেনাবাহিনী হায়দরাবাদে প্রবেশ করেছে। আর তাদের ফেরানো সম্ভব নয়।
প্রকৃতপক্ষে, নেহরুর উদ্বেগ ছিল যে পাকিস্তান কোনও
প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ না নিয়ে বসে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই অভিযানের
নামকরণ করা হয়েছিল অপারেশন পোলো কারণ সেই সময়ে হায়দরাবাদে বিশ্বের সর্বাধিক
১৭টি পোলো গ্রাউন্ড ছিল। পাকিস্তানও চুপ করে বসে ছিল না। ভারতীয় সেনাবাহিনী
হায়দরাবাদে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত
আলী খান প্রতিরক্ষা পরিষদের একটি বৈঠক ডাকেন। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, হায়দরাবাদে পাকিস্তান কোনও ব্যবস্থা নিতে পারে কিনা? বৈঠকে উপস্থিত গ্রুপ ক্যাপ্টেন এলওয়ার্ডি (যিনি পরে এয়ার
চিফ মার্শাল এবং ব্রিটেনের প্রথম চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ হয়েছিলেন) উত্তর দেন, 'না।'
লিয়াকত জোর দিয়ে বলেছিলেন, 'আমরা কি দিল্লিতে বোমা ফেলতে পারি না?' এলওয়ার্ডির উত্তর ছিল, “হ্যাঁ, তা সম্ভব। কিন্তু পাকিস্তানের কাছে মোট চারটি বোমারু বিমান আছে, যার মধ্যে মাত্র দুটি কাজ করছে। তাদের মধ্যে একটি যদিও বা
দিল্লি পৌঁছানোর পর বোমা ফেলতেও পারে, কিন্তু দুটোর কোনওটাই কিন্তু আর পাকিস্তানে ফিরে আসতে পারবে না।
হায়দরাবাদে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অভিযান
পাঁচ দিন ধরে চলে, যাতে ১৩৭৩ জন
রাজাকার নিহত হয়। নিজামের রাজ্যের ৮০৭ জন সেনাও নিহত হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী ৬৬
জন সৈন্য হারায়, ৯৬ জন আহত হয়। পাকিস্তানের
প্রতিষ্ঠাতা মহম্মদ আলি জিন্নাহ ভারতীয় সেনাবাহিনীর অভিযান শুরুর দুই দিন আগে
১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মারা যান।
এরপর পাকিস্তান আবার জাতিসংঘে
বিষয়টি উত্থাপনের চেষ্টা করে, তাতে সফলও হয়। এই
সময় আট সদস্য ভোট দিয়ে বলে যে এটি বিবেচনা করে দেখা উচিত। সোভিয়েত ইউনিয়ন, চিন এবং ইউক্রেন নিরপেক্ষ থেকে ক্রমাগত ভারতকে সমর্থন
করেছিল। এই বিষয়টি যদি জাতিসংঘে উঠত, তাহলে পাকিস্তান আন্তর্জাতিকভাবে অনেক সুবিধা পেতে পারত।
জাতিসংঘে বিষয়টি বিবেচনার জন্য ১৭
সেপ্টেম্বর তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল। এর একদিন আগে হায়দরাবাদের নিজাম ওসমান
আলি খান আত্মসমর্পণ করেন। পাকিস্তান ও তার সমর্থকদের মুখ পোড়ে। ভারতীয়
প্রতিনিধিরা বৈঠকে যোগ না দেওয়ায় যা কিছু বাকি ছিল তা সম্পূর্ণ হয়। প্যাটেলের
প্রবল দূরদর্শিতায় অবশেষে হায়দরাবাদ ভারতেরই অন্তর্ভূক্ত হয়।