মানব চরিত্রের বিভিন্ন দিক রয়েছে। কেউ ভাল হন, কেউ বা মন্দ। মন্দ হওয়ার বিষয় যখনই আসে, তখন মনে হয় এর নেপথ্যে কোনও কারণ রয়েছে। অন্তত অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাই দেখা যায়। গান্ধাররাজ শকুনি কুরু বংশ ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। তার নেপথ্যেও তো নিশ্চয় কারণ ছিল। আশ্চর্যের বিষয় হল, অধিকাংশ মানুষই সেই কারণ সম্পর্কে খোঁজ খবর করতে নারাজ। আজ বরং জানা যাক গান্ধাররাজের এই প্রতিহিংসা পরায়নতার কারণ কী? কেন বলা হয় তিনি না থাকলে প্রবল ধ্বংসকারী কুরুক্ষেত্র যুদ্ধই হত না।
পাশা খেলার ছলনা দ্বারা পরাজিত করা হোক বা লাক্ষাগৃহে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা হোক- পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে হওয়া প্রতিটি কুটিলতার নেপথ্যে শকুনির হাত ছিল। তিনি এই সব কিছু করতেন শুধু ভাগ্নেদের জন্য যদি এমনটা ভেবে থাকেন তবে বলতে হয়, ব্যাপারটা মোটেও এমন ছিল না। এমন অনেক কিংবদন্তি রয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে যে শকুনি নিজের বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কৌরবদের ব্যবহার করেছিলেন। তিনি এখানে এসেছিলেন ভগ্নিপতি ধৃতরাষ্ট্রের করা তাঁর পিতার উপর হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে। শকুনি জানতেন যে কৌরবরা কখনওই পাণ্ডবদের হারিয়ে জয়লাভ করতে পারবে না। তবুও গান্ধাররাজ কৌরবদের যুদ্ধের জন্যই প্ররোচিত করেছিলেন। কৌরবদের পরাজয়ের মাধ্যমে নিজের প্রতিশোধস্পৃহা সম্পূর্ণ করেছিলেন।
ধৃতরাষ্ট্র ও কৌরবদের সঙ্গে শকুনির শত্রুতার দুটি প্রধান কারণ রয়েছে। প্রথম কারণ অন্ধ রাজার সাথে বোন গান্ধারীর বিয়ে। গান্ধারীকে বিয়ে করার পর হস্তিনাপুরের রাজা গান্ধাররাজ সুবলকে পরাজিত করেছিলেন। আসলে ধৃতরাষ্ট্র আগে জানতেন না যে গান্ধারীর মাঙ্গলিক দোষ কাটানোর জন্য ধৃতরাষ্ট্রের আগে একটি ছাগের সাথে তাঁর বিয়ে দেওয়া হয় এবং পরে ছাগটিকে হত্যা করা হয়। তাই সেভাবে দেখতে গেলে গান্ধারী ছিলেন ছাগের বিধবা। বিষয়টি জানতে পেরে ধৃতরাষ্ট্র রাজা সুবল ও শকুনিসহ গান্ধাররাজের ১০০ জন পুত্রকে বন্দি করেন। কারাগারে তাঁদের সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করা হত। প্রতিদিন মাত্র এক মুঠো ভাত দেওয়া হত, যা সবাই মিলে খেতেন। ক্রমান্বয়ে রাজা সুবলের প্রত্যেক পুত্রই ক্ষুধার জ্বালায় মারা যান। শেষে গান্ধাররাজ সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি তাঁর বংশের অবসান হতে দেবেন না। তাই স্থির হল যে, যে কয়েকজন জীবিত রয়েছেন সকলেই তাঁদের ভাগের অন্ন ত্যাগ করে শকুনিকে দেবেন। সময়ের সাথে সাথে রাজা সুবল দুর্বল হয়ে পড়েন। তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে অনুরোধ করলেন শকুনিকে মুক্তি দিতে। এর বিনিময়ে শকুনি সর্বদা কৌরবদের সাথে থাকবেন এমন প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। ধৃতরাষ্ট্র এটাকে শ্বশুরের শেষ ইচ্ছা হিসেবে মেনে নিয়ে শকুনিকে হস্তিনাপুরে নিয়ে আসেন, কিন্তু শকুনি কখনও এই অপমান ভুলে যাননি।
রাজা সুবল অসুস্থ অবস্থায় মৃত্যুর আগে শকুনিকে তার অস্থি থেকে পাশা তৈরি করতে বলেছিলেন। বলে গিয়েছিলেন সেই পাশা পুত্রের ইচ্ছা অনুযায়ী চলবে। সুবল চেয়েছিলেন এই পাশা দিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের রাজবংশের অবসান করতে। সেই সাথে শকুনির একটি পা খোঁড়া করে দেওয়া হয়েছিল যাতে তিনি বাবাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি সবসময় মনে রাখেন এবং বাবা ও ভাইদের অপমানের প্রতিশোধ নেন।
শকুনি পিতার ইচ্ছা পূরণের জন্য নিজের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেছিলেন। যখন পাণ্ডব ও কৌরবদের মধ্যে পাশা খেলা হয়েছিল, তিনি পিতার অস্থি থেকে তৈরি পাশা ব্যবহার করেছিলেন। এতে যুধিষ্ঠির স্ত্রী দ্রৌপদী সহ সকল ভাইদের হারান। এর পরে, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের চেষ্টা করা হয়, যা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের কারণ হয়ে ওঠে।