যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন পরিচালকের কারণে ভারত
বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচিয়ে রয়েছে, তাঁদের মধ্যে সত্যজিৎ রায় অন্যতম। কথায় বলে
রক্ত কথা বলে। দাদু উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, বাবা সুকুমার রায়ের রক্ত বইছে যার
ধমনীতে, তিনি যে অন্য ধারাতেই বইবেন তাই স্বাভাবিক। বরং উপেন্দ্র-সুকুমারের প্রতি
শ্রদ্ধা রেখেই বলা যায় কোনও কোনও ক্ষেত্রে মানিক-রতন ছাপিয়ে গিয়েছেন তাঁর
পূর্বপুরুষদেরও।
শতবর্ষে মৃণাল সেনকে শ্রদ্ধা অঞ্জনের, ‘চালচিত্র এখন’ মুক্তি পেতে চলেছে প্রেক্ষাগৃহে
পরিচালনার জন্য যখনই ভারতের বড় বড় চলচ্চিত্র
পরিচালকদের কথা আসে, তখনই অবধারিতভাবেই চলে আসে সত্যজিৎ রায়ের নাম। তিনি তাঁর
পরিচালক জীবন শুরু করেছিলেন পথের পাঁচালি দিয়ে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই
কালজয়ী উপন্যাস, চিরায়িত ভাই বোনের খুনসুঁটি-ভালবাসার সম্পর্ককে বইয়ের পাতা থেকে
সিনেমার পর্দায় তুলে নিয়ে এসেছিলেন সত্যজিৎ। নিজের স্বপ্নপূরণ করতে প্রচুর কাঠখড়
পোড়াতে হয়েছে তাঁকে। সিনেমার শুটিং শুরু করেছেন, অর্থ শেষ শুটিংও শেষ। আবার যখন
অর্থ আসে তখন শুটিং হয়। কীভাবে হয়েছিল ‘পথের
পাঁচালি’র শুটিং, বিশ্ববরেণ্য পরিচালকের জন্মদিনে আজ শোনা যাক সেই গল্প।
১৯৫৫ সালে সত্যজিৎ রায় নির্মাণ করেন প্রথম
চলচ্চিত্র 'পথের পাঁচালী'। এই ছবির শুটিং করতে আড়াই বছর সময় লেগেছিল। ‘পথের
পাঁচালি’র একটি ছোট দৃশ্যের শুটিং করতে বেশ কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হয়েছিল। সিনেমাটি ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ
বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১৯২৯ সালে রচিত একই নামের বাংলা উপন্যাসের রূপান্তর। বর্তমানে
সিনেমা নির্মাণ অনেক সহজ। এখন পরিচালকরা ভিএফএক্স, ক্রোমা এবং অন্য বিভিন্ন কৌশল
ব্যবহার করে চলচ্চিত্র তৈরি করেন। একটা সময় তো এই সমস্ত কৌশল সহজে পাওয়া যেত না। সেই
সময় চলচ্চিত্রে অভিনেতা অভিনেত্রী পাওয়াও জলভাত ছিল না। তাই সত্যজিৎ রায় যখন পথের
পাঁচালী নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন সেই সময়ে ছবিটি সম্পূর্ণ হবে কি না তা নিয়ে
পরিচালক মহাশয়েরই নিদারুণ সন্দেহ ছিল। সত্যজিৎ সেই সময় তিনি একটি বিজ্ঞাপনী
সংস্থায় কাজ করছেন। সংসার চালানোর জন্য সেই কাজ করতেই হবে, এদিকে প্রবল শখ সিনেমা
নির্মাণের। তাই সেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে
সিনেমার শুটিং করতেন মানিকবাবু।
ভারতে এসে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হলেন বাংলাদেশের সঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা
সিনেমা তৈরির জন্য দরকার ছিল টাকার। সত্যজিতের
তখন এত আর্থিক সংস্থান কোথায়! তাই যখনই টাকা ফুরিয়ে যেত, তখনই তিনি শুটিংয়ের কাজ
বন্ধ করে দিতেন।
ছবির প্রধান চরিত্র অপু নামের একটি বছর ছয়েকের
ছেলে। তাকে খুঁজে পাওয়াও সহজ ছিল না। একদিন সত্যজিৎ রায়ের স্ত্রী পাশের বাড়ির
বারান্দায় একটি ছেলেকে দেখতে পান, যে অপুর চরিত্রে অভিনয়ের জন্য উপযুক্ত ছিল।
পথের পাঁচালীর অপুর জন্য তাকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। সেই ছেলেটির নাম ছিল সুবীর
ব্যানার্জি। আড়াই বছর ধরে যে ছবিটির কাজ চলবে সে সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না
সত্যজিতের।
ছবিটির একটি দৃশ্যের জন্য কয়েক মাস অপেক্ষা
করতে হয়েছিল। আসলে, ছবিটিতে একটি বড় দৃশ্য ছিল, যেটি কলকাতা থেকে ৭০ মাইল দূরে
পালসিট নামে একটি গ্রামে শুট করা হয়েছিল। যখন তিনি স্থানটি দেখতে যান তখন সেখানে
কাশফুলে ভরা চারদিক। দৃশ্যটি ছিল এমন যে অপু দুর্গা প্রথমবার ট্রেন দেখতে পেয়েছে।
দুজনেই দৌড়াচ্ছে। এই গোটা দৃশ্যের শুটিং একদিনে সম্ভব ছিল না। সকাল থেকে সন্ধ্যা
পর্যন্ত অর্ধেক দৃশ্যের শুটিং সম্ভব হয়েছিল। শিল্পী থেকে পরিচালক সকলে সাত দিন পর
যখন সেখানে পৌঁছালেন, তখন আর ওই জায়গায় কাশফুল ছিল না। পশুরা সেই সব ফুল খেয়ে
ফেলেছিল। ওই অবস্থায় শুট করা হলে প্রথম অংশের সঙ্গে শটের অংশ মিলত না। তাই সেই
দৃশ্যটি পরের বছর শরৎকালে আবার শ্যুট করা হয়েছিল যখন চারদিক কাশফুলে ভরা।
পাহাড়প্রমাণ সমস্যাদের অতিক্রম করে সত্যজিৎ রায়
তাঁর প্রথম সিনেমা পথের পাঁচালি নির্মান করেছিলেন। যে উপন্যাসকে কেন্দ্র করে এই
ছবি সেখানে অপু ও দুর্গার একটি পোষা কুকুরের কথাও বলা হয়েছে। এর জন্য বোড়াল গ্রাম
থেকেই একটি কুকুর নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বেশ কিছুদিনের মধ্যে সত্যজিৎ টিমের সঙ্গে
তার খুব বন্ধুত্ব হয়ে যায়। কুকুরটির নাম ছিল ভুলো। ভুলোর সঙ্গে সিনেমার কিছু শুটিং
হয়েছিল, বাকি শুটিং করতে তিনি যখন ছ’মাস পর বোড়ালে আসেন তখন ভুলো মারা গিয়েছে।
এরপর জানা গেল, ভুলোর মতো গ্রামে আর একটি কুকুর রয়েছে, যেটি দেখতে হুবহু ভুলোর
মতো। এরপর একই কুকুরের সঙ্গে বাকি দৃশ্যের শুটিং করা হয়।
ছবিতে একটি দৃশ্য ছিল যে শ্রীনিবাস নামে এক
মিষ্টি বিক্রেতা যিনি ঘোরাঘুরি করে মিষ্টি বিক্রি করেন। কিছুটা শুটিং করার পর
সত্যজিৎ চলে যান। তারপর কয়েক মাস পরে যখন টাকা হাতে আসে তখন মানিকবাবু আবার
শুটিংয়ের জন্য আসেন। কিন্তু এসে জানতে পারেন যে শ্রীনিবাস মারা গেছেন। এবার
সমস্যা দেখা দিল যে শ্রীনিবাসের মতো দেখতে লোক কোথায় পাওয়া যাবে। অনেক খুঁজে
একজনকে পাওয়া গেছে, যাকে দেখতে শ্রীনিবাসের মতো নয়, কিন্তু শারীরিক গঠন তাঁর মতো।
তাই তিনিই শেষ পর্যন্ত শ্রীনিবাসের ভূমিকায় অভিনয় করে সত্যজিৎ রায়কে বাঁচান।
একই সঙ্গে সিনেমায় বৃষ্টির দৃশ্যের শুটিংয়েও
নানা সমস্যা দেখা দিয়েছিল। টাকার অভাবে শুটিং করা সম্ভব হয়নি। বর্ষা এল আর গেল,
কিন্তু শুটিং হল না। টাকা যখন এল তখন অক্টোবর মাস। সত্যজিৎ রায়ের আশা ছিল আকাশে
কালো মেঘ থাকলে শুটিং হবে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে সেই দিন এল। সম্পূর্ণ হল
শুটিং।