সত্যজিৎ রায় একটি প্রতিষ্ঠানের নাম। সিনেমা থেকে নাটক, গল্প থেকে ছবি আঁকা, গান লেখা- সব কিছুতেই ছিল তাঁর বহুমুখী প্রতিভা। ইংরেজিতে বহুল প্রচলিত ‘আনডাউটেডলি আ জায়েন্ট ইন দ্য ফিল্ম ওয়ার্ল্ড’ বাক্যটি সত্যজিৎ রায়ের জন্য একেবারে যথাযথ। বহু বিদেশি পরিচালক মাণিকের সিনেমা খুঁটিয়ে দেখেছেন, তাঁরা একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন হলিউডে কাজ করলে সত্যজিৎ অন্যান্য বহু পরিচালকের ভাত মারতে পারতেন। সুকুমার-পুত্র সম্পর্কে বিশ্ববরেণ্য বহু প্রথিতযশা পরিচালক বিভিন্ন সময় নানা মন্তব্য করেছেন। আজ শোনা যাক সেই সংক্রান্ত তথ্যই।

মার্টিন স্করসেস

বর্তমানে অনুরাগ কাশ্যপের সিনেমা মনে করায় মার্টিন স্করসেসকে। ‘দ্য র‍্যাগিং বুল’ পরিচালক দুই প্রথিতযশা ভারতীয়র অনুরাগী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন যদি উদয় শঙ্কর হন, দ্বিতীয় জন অবশ্যই সত্যজিৎ রায়। স্করসেস সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে একবার বলেছিলেন, “সত্যজিৎ রায়ের কর্মশৈলীর আমি একজন গভীর অনুরাগী। তাঁর সঙ্গে আমার বেশ কয়েকবার কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। সেই সব সুমধুর মুহূর্ত আমি আমার স্মৃতির সিন্দুকে যত্ন করে রেখে দিয়েছি।”

আরও পড়ুন: আজও সমাধান হয়নি তিরুপতি বালাজি মন্দিরের এই সব রহস্যের

ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা

‘দ্য গডফাদার’ সিরিজের পরিচালক কপোলা ‘রে’ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, “যখনই কলকাতা থেকে কেউ আমায় ফোন করেন, আমার মনে পরে যায় সত্যজিৎ রায়ের কথা। এই ভাবেই ফোন করে আমার গডফাদার আইয়ের প্রশংসা করেছিলেন তিনি। আলফার্দো জেমস পাসিনো ছিলেন ১৯৭০ এর দিকের সত্যজিতের প্রিয় অভিনেতা। আলফার্দো ছিলেন আমারই আবিষ্কার, আর সেই জন্য সত্যজিৎ রায় আমার বিশেষভাবে প্রশংসা করেছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল, ‘দ্য গডফাদার’-এ মার্লিন ব্র্যান্ডোর অভিনয়ের উচ্চতায় কেউ কোনওদিন উঠতে পারবে না। আমরা ভারতীয় চলচ্চিত্রকে জেনেছি রে’র কাজের মধ্য দিয়েই। আমার কাছে তাঁর পরিচালিত ‘দেবী’ চলচ্চিত্র জগতের মাইলস্টোন।”

আকিরা কুরোসাভা

১৯৭৫ সালে বিশ্ববরেন্য জাপানি পরিচালক আকিরা কুরোসাভা বলেছিলেন, “ধীর অথচ গভীর পর্যবেক্ষণ, জীবনের দৌড়ে মানুষের ভালবাসার মতো বিষয়গুলি ছিল সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার বৈশিষ্ট্য যা আমাকে ভীষনভাবে আকৃষ্ট করত। আমি মনে করি চলচ্চিত্র জগতে সত্যজিৎ রায় একজন বিশালাকার ‘দৈত্য’। রে’র সিনেমা যে দেখেনি তাঁকে বলতে হয় সে এই পৃথিবীতে বসবাস করছে সূর্য-চন্দ্র দর্শন না করেই। ‘পথের পাঁচালি’ দেখে আমার মনের মধ্যে যে অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল তা কোনওদিনই ভোলা সম্ভব নয়।”

এলিয়া কাজান

‘অন দ্য ওয়াটারফ্রন্ট’, ‘আ স্ট্রিটকার নেমড ডিজায়ার’র মতো ক্লাসিক সিনেমার পরিচালক এলিয়া কাজান ১৯৬০ সালে কলকাতায় এসে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে বেশ কিছুটা সময় কাটান। সত্যজিৎ সম্পর্কে তাঁর গভীর মনোস্তত্ত্ব ‘রে’র মধ্যে আমি একজন সম্পূর্ণ পরিচালককে দেখেছিলাম। চিত্রনাট্য, পরিচালনা, সম্পাদনা, সঙ্গীত নির্বাচন সবক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সেরা। বিশ্বে খুব কম মানুষকেই তাঁর সঙ্গে তুলনা করা যায়। বলতে দ্বিধা নেই, যদি রে হলিউডে কাজ করতেন, তবে আমাদের জন্য তা কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াত। ‘পথের পাঁচালি’র সারল্য, ‘দেবী’র তীক্ষ্ণতা, ‘চারুলতা’র নান্দনিকতা আর পাঁচজন পরিচালকের মতো আমাকেও ভাবিয়ে তুলেছিল।”

আরও পড়ুন: হঠাত্‍ই মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করলে, বাড়িতে থাকা সাধারণ উপকরণ দিয়েই বানিয়ে ফেলুন 'ডোনাট বাইটস'

আলেকজান্ডার পেইন

“আমি বেশিরভাগই পুরনো সিনেমা দেখতে ভালবাসি। সম্প্রতি ‘জলসাঘর’ দেখলাম। এক নিঃশ্বাসে দেখার মতো, অবিশ্বাস্য সিনেমা। এমন অনেক দূর্দান্ত পুরনো সিনেমা রয়েছে যা হয়তো মানুষের খুব ভাল লাগে, কিন্তু আমি না দেখে বিশ্বাস করি না।”

খ্রিস্টোফার নোলান

‘পথের পাঁচালি’ সম্পর্কে নোলানের বক্তব্য, “সম্প্রতি ‘পথের পাঁচালি’ দেখতে দেখতে মুগ্ধ হচ্ছিলাম, আগে তো দেখিনি কখনও। আমার মনে হয় এখনও পর্যন্ত যত সিনেমা তৈরি হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম সেরা সিনেমা এটি। শিল্পের এ এক অনন্য নজির।”

কিনু রিভস

“ছোটবেলায় ভারত সম্পর্কে জানার বোঝার আমার একমাত্র মাধ্যম ছিল সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা। সিনেমাগুলি একের পর এক চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হত। অনবদ্য ছিল সে’সব।”

আদ্রে হেপবার্ন

শশী কপুর, আদ্রে হেপবার্ন ও মিচেল ব্র্যান্ডোকে নিয়ে একটি হলিউড সিনেমা বানানোর পরিকল্পনা করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। দুর্ভাগ্যের বিষয় তা সম্ভব হয়নি। ১৯৯১ সালে সত্যজিৎ যখন সাম্মানিক অস্কার পান তখন আদ্রে বলেছিলেন, “অন্যতম সেরা পরিচালক শেষ পর্যন্ত প্রাপ্য সম্মানটুকু পেলেন।”

রিচার্ড অ্যাটেনবোরা

সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’তে জেনারেল আউট্রামের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন রিচার্ড অ্যাটেনবোরা। তিনি সত্যজিৎ সম্পর্কে বলেছিলেন, “আমি এই ভেবেই সম্মানিত বোধ করি যে বিশ্বের তাবড় তাবড় পরিচালকরা তাঁদের সিনেমায় আমাকে দিয়ে অভিনয় করানোর ইচ্ছা প্রকাশ করতেন। সত্যজিৎ রায়ের প্রতি আমার আমিত্বকে সম্পূর্ণভাবে সমর্পন করেছিলাম, আর দেখেছিলাম এক জন পরিচালক কিভাবে অসাধারণ অভিনেতা হয়ে উঠছেন। চিত্রনাট্য সম্পর্কে তাঁর যা বিশদ চিন্তাভাবনা ছিল তা তুলনাহীন।”