বাঙালির মহালয়া যাঁকে ছাড়া অসম্পূর্ণ তিনি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। হলফ করে বলা যায় শ্রদ্ধেয় এই মানুষটি না থাকলে বঙ্গজনের মহালয়ার ভোর বড় বিস্বাদ ঠেকতো। ব্যক্তিগত জীবনে কেমন ছিলেন বাঙালির প্রিয় কণ্ঠস্বরের অধিকারী মানুষটি?
যতদিন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র সুস্থ ছিলেন রেডিওর শিল্পীরা এই দিন বাড়িতে আসতেন। জমিয়ে খাওয়া দাওয়া হত। যতদিন শয্যাশায়ী হননি, নিজের ঘরে সবার সঙ্গে বসেই অনুষ্ঠান শুনতেন। কখনও আবার আকাশবাণীর অফিসে চলে যেতেন। তাঁর ঘরও সাজিয়ে রাখা হয়েছে ঠিক আগের মতোই। খাট, ব্যবহৃত আসবাব, টেবিল, যে রেডিওতে নিজের সৃষ্টি শুনতেন, সেটাও রাখা আছে একই ভাবে।
কোনওদিনই পুজো বা ঠাকুরঘরের ছায়াও মাড়াতেন না। স্তোত্রপাঠ করতে করতে কিছু জায়গায় বীরূপাক্ষের মনে হত দেবী বুঝি স্বয়ং সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। একটা অলৌকিক শক্তি অনুভব করতে পারতেন উনি।
১৯৭৬ সালে আকাশবাণীতে মহিষাসুরমর্দিনীর জায়গায় সম্প্রচারিত হয়েছিল দেবীং দুর্গতিহারিণী। চণদিপাঠ করেছিলেন স্বয়ং মহানায়ক। তিনি কিন্তু তাঁর বীরেনদার অনুমতি ছাড়া এই কাজ করতে রাজি ছিলেন না। এমনকি এও জানিয়েছিলেন যে, বীরেনদা’র অনুমতি না পেলে তিনি মোটেই রেডিওর প্রস্তাব গ্রহণ করবেন না। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র কিন্তু বাধা দেননি। উনি বরাবরই নতুনদের জায়গা করে দেওয়ার পক্ষপাতি ছিলেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই মহানায়ককে বলেন যে তিনি খুব খুশি হবেন উত্তম কুমার অনুষ্ঠানটি করলে।
কিন্তু মহিষাসুরমর্দিনীর জায়গায় দেবীং দুর্গতিহারিণী সম্প্রচারিত হওয়াই এমনই জনরোষ পড়ল অল ইন্ডিয়া রেডিওর ওপর যে প্রথা ভেঙে তারা সেই বছরই মহাষষ্ঠীতে মহিষাসুরমর্দিনী ব্রডকাস্ট করতে বাধ্য হলেন।
১৯৯১ সালের ৪ নভেম্বর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র অমৃতলোকে যাত্রা করেন। বেতারে আক্ষরিক অর্থে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত করেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। কিন্তু বেতার কি তাঁকে যথাযোগ্য সম্মান দিতে পেরেছে? বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র কোনওদিন তো অল ইন্ডিয়া রেডিওর কর্মী সেইভাবে ছিলেন না। উনি ছিলেন চুক্তিভিত্তিক কর্মী। প্রতি বছর এই চুক্তির নবীকরণ হত। বারবার প্রস্তাব আসলেও বীরূপাক্ষ কখনও পার্মানেন্ট এমপ্লয়ি হতে চাননি। আসলে তাঁর দৃঢ় ধারণা ছিল, পার্মানেন্ট এমপ্লয়ি হলে চিরকাল রেডিও স্টেশন এবং কেন্দ্রের আমলাদের কথায় উঠতে বসতে হবে। আর চুক্তিভিত্তিক কর্মী ছিলেন বলে শেষ জীবনে সামান্য পেনশনেরও ব্যবস্থা করে দেয়নি বেতার। উপার্জনের জন্য সামান্য অর্থের বিনিময়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হতেন। এমনকি প্রতিমার আবরণ উন্মোচনও করতেন, চণ্ডীপাঠ করতেন। কিন্তু মানুষ যে তাঁকে ভোলেনি তাঁর উদাহরণ বছর বছর আসা মহালয়া। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠ না শুনলে বাঙালির যে পুজোই শুরু হয় না।