মহাভারতের যুদ্ধের সবচেয়ে বড় খলনায়ক ধৃতরাষ্ট্র। তিনি সন্তানস্নেহে এতটাই
অন্ধ ছিলেন যে তাঁর কারণে সমগ্র কুরু রাজবংশকে ধ্বংস হতে হয়েছিল। কিন্তু আপনি কি জানেন
যে ধৃতরাষ্ট্রের জন্ম থেকেই অন্ধ হওয়া বা দগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া ছিল তাঁর পাপের ফল।
তিনি এমন ৮টি পাপ করেছিলেন, যার কারণে তাঁকে এই সব ভোগ করতে হয়েছিল।
গান্ধারীর সাথে প্রতারণা করা ছিল ধৃতরাষ্ট্রের প্রথম পাপ। কারণ গান্ধারীকে
বিয়ের সময় বলা হয়নি যে ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ। ভীষ্ম পিতামহ ধৃতরাষ্ট্রকে গান্ধারীর সাথে
বিবাহ দিয়েছিলেন এবং ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধত্বের কথা জানতে পেরে গান্ধারীও স্ত্রীর ধর্ম
অনুসরণ করে তাঁর চোখ বেঁধে রাখতেন।
ধৃতরাষ্ট্রের দ্বিতীয় পাপ ছিল গান্ধারীর পরিবারকে বন্দি করে যন্ত্রণার
মতো মৃত্যু ঘটানো। ধৃতরাষ্ট্র যখন জানতে পারলেন যে গান্ধারী মাঙ্গলিক, তখন তার সঙ্গে
একটি ছাগলের বিয়ে দেন। এরপর ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। যাতে কুরুসম্রাট যে
কোন প্রকার বিপদ থেকে রক্ষা পান। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারীর পিতা রাজা সুবলকে দোষারোপ
করেন এবং তাঁকে ও পুরো পরিবারকে কারাগারে বন্দি করেন। শুধু একজনের পেট ভরার মতো খাবার
কারাগারে দেওয়া হত। রাজা সুবল সেই সমস্ত খাবার তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র শকুনিকে দিতেন যাতে
তার বংশের কেউ বেঁচে থাকতে পারে এবং ধৃতরাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রতিশোধ নিতে পারে।
ধৃতরাষ্ট্রের তৃতীয় পাপ ছিল দাসীর সঙ্গে সহবাস। গান্ধারীর (যাদের কৌরব
বলা হত) পুত্রদের কেউই কৌরব বংশের ছিল না। গান্ধারী কন্যা সন্তান লাভের জন্য মহর্ষি
বেদ ব্যাসের কাছ থেকে আশীর্বাদ পেয়েছিলেন। তারপর তিনি দুই বছর পর ৯৯টি পুত্র ও এক
কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। অন্যদিকে, গান্ধারী যখন গর্ভবতী ছিলেন, তখন ধৃতরাষ্ট্র তাঁর
দাসীর সাথে সহবাস করেছিলেন। তাদের একটি পুত্র ছিল, যার নাম ছিল যুযুৎসু। তারপর কৌরবদের
সংখ্যা ৯৯ থেকে ১০০-তে উন্নীত হয়।
ধৃতরাষ্ট্রের চতুর্থ পাপ ছিল পাণ্ডবদের প্রতি অবিচার করা। তিনি জানতেন পুত্রের
প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে তিনি পাণ্ডবদের প্রতি যে অধর্ম করছেন তা ঠিক নয়। কিন্তু তারপরও
একই কাজ করেছিলেন এবং পুরো রাজবংশকে ধ্বংস করেছিলেন। মহাভারতের যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য
মহাত্মা বিদুর তাঁকে অনেকবার বুঝিয়েছিলেন এবং যুদ্ধের ফলাফলের কথা বলেছিলেন, কিন্তু
সব কিছু জেনেও ধৃতরাষ্ট্র নীরব হয়ে ছিলেন। বরং শুধুমাত্র দুর্যোধন ও শকুনির আনুগত্য
করেছিলেন।
আরও পড়ুন: এই পরিবারে নামেই রয়েছে নোবেল জয়ের রেকর্ড, জেনে নিন স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে কত পুরস্কার জিতেছেন
আরও পড়ুন: স্ত্রী শব্দ এল কোথা থেকে
পঞ্চম পাপ ছিল দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময় ধৃতরাষ্ট্রের নীরবতা। এটা বলা
মোটেও ভুল নয় যে এটি একটি ঘটনা যা মহাভারত যুদ্ধের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। দ্রৌপদীর
বস্ত্রহরণের ঘটনা এমন প্রতিহিংসার আগুনের জন্ম দেয় যে তার থেকে হয় ভয়ঙ্কর কুরুক্ষেত্রের
যুদ্ধ।
ধৃতরাষ্ট্রের ষষ্ঠ পাপ ছিল তার ভাইয়ের সন্তানদের অধিকার হরণ করা। যদিও
তিনি নিজে এ কাজ করেননি। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন পাণ্ডবদের জন্য মাত্র পাঁচটি গ্রাম
চেয়েছিলেন, তখন দুর্যোধনের প্রত্যাখ্যানে ধৃতরাষ্ট্রের নীরবতাও ছিল পুত্রস্নেহে অন্ধ
হয়ে অন্যায়কে সমর্থন করা।
ভীমকে হত্যা করার ইচ্ছা ছিল ধৃতরাষ্ট্রের সপ্তম পাপ। মহাভারত শেষ হলে সব
পাণ্ডব ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। সেখানে ভীম ছাড়া সবাই ধৃতরাষ্ট্রকে প্রণাম
করলেন। ভীমের পালা এলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভীমকে থামিয়ে ভীমের জায়গায় লৌহভীম এগিয়ে
দেন। পুত্রদের হত্যায় ধৃতরাষ্ট্র অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন
যে ভীম তাঁর সামনে রয়েছেন, তাই তিনি তাঁকে শক্ত করে ধরে ভেঙে ফেললেন। কিন্তু রাগ কমে
গেলে ভীমকে মৃত ভেবে কাঁদতে থাকলেন। সেই সাথে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বললেন যে তিনি
তাঁর ক্রোধের আগুন জানেন, তাই ভীমের পরিবর্তে তাঁর আকারের মূর্তিটি সামনে রাখা হয়েছিল।
এইভাবে শ্রীকৃষ্ণ ভীমকে ধৃতরাষ্ট্রের ক্রোধ থেকে রক্ষা করেছিলেন।
অষ্টম পাপ ছিল ধৃতরাষ্ট্রের পূর্বজন্মের। সে সময় তিনি ছিলেন অত্যন্ত নির্দয়
রাজা। একদিন তিনি হ্রদে গিয়ে দেখলেন একটি রাজহাঁস তার সন্তানদের নিয়ে সেখানে বসবাস
করছেন। তারপর তিনি তাঁর সৈন্যদের সেই রাজহাঁসের চোখ তুলে নিতে নির্দেশ দিলেন। সৈন্যরাও
তাই করেছিল। হঙ্গসটি মারা যয়। মারা যায় সন্তানরাও। হংসটি মৃত্যুর সময় ধৃতরাষ্ট্রকে
অভিশাপ দিয়েছিলেন যে, সে যেমন তাঁর চোখ ও পুত্রের ক্ষতির শিকার হয়েছেন, ধৃতরাষ্ট্রেরও
একই পরিণতি ঘটবে। মহাভারত যুদ্ধ শেষ হওয়ার ১৫ বছর কেটে গিয়েছে। ধৃতরাষ্ট্র, কুন্তী,
গান্ধারী ও সঞ্জয় বনে গেলেন। একদিন ধৃতরাষ্ট্র গঙ্গায় স্নান করতে গেলে হঠাৎ বনে আগুন
লেগে যায়। খবর পেয়ে গান্ধারী, কুন্তী ও সঞ্জয় বনের দিকে এগিয়ে গেলেন। যেখানে সবাই
ধৃতরাষ্ট্রকে বের হয়ে আসতে বললো কিন্তু শারীরিকভাবে দুর্বল হওয়ার কারণে বের হতে পারেনি।
তখন তিনি সঞ্জয়, গান্ধারী ও কুন্তীকে বন ছেড়ে চলে যেতে বলেন। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রকে
আগুনে দেখে গান্ধারী ও কুন্তীও তাঁকে ত্যাগ না করার সিদ্ধান্ত নেন। এভাবে ধৃতরাষ্ট্রের
সঙ্গে গান্ধারী ও কুন্তীরও মৃত্যু হয়।