রবীন্দ্রসঙ্গীত হোক বা নজরুল গীতির পাশাপাশি আজ শ্রোতাদের মনে জায়গা করে নিয়েছে বিভিন্ন ধরনের ব‌্যান্ডের গানও। তার মধ‌্যে অন‌্যতম হল ‘ক‌্যাকটাস’। আর এই ব‌্যান্ড মানেই একটাই নাম তা হল গায়ক সিধু। ‘সেই যে হলুদ পাখি’ থেকে শুরু করে ‘আমি শুধু চেয়েছি তোমায়’ সকল ভক্তই মাঝে মধ‌্যে গুনগুনিয়ে ওঠেন। তাঁর লাইভ অনুষ্ঠান দেখার জন‌্য মুখিয়ে থাকেন অনুরাগীরা। একটি সন্ধ্যার অভিজ্ঞতা বদলে দিয়েছিল সিদ্ধার্থ সরকার ওরফে সিধুর জীবন। বিষয়টি শুনলে আপনিও হয়তো অবাক হয়ে যাবেন।

যে সন্ধ্যাটি না এলে হয়তো আজকে দাঁড়িয়ে একজন চিকিৎসক হিসেবেই তিনি থাকতেন। কিন্তু সেই সন্ধ‌্যায় তাঁর জীবনের মোড় বদলে দিয়েছিল। ২০০৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা মাঝপথে ছেড়ে দেন সিধু। জীবিকা হিসেবে সঙ্গীতকেই বেছে নেন তিনি। কেমন এমন সিদ্ধন্ত? ভক্তদের মধ‌্যেও নানা মতো পার্থক‌্য রয়েছে। সম্প্রতি আনন্দবাজার অনলাইনের একটি সাক্ষাৎকারে সমস্ত ঘটনাই জানিয়েছেন সিধু।

‘ক্যাকটাস’-এর প্রথম অ্যালবাম প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালে। একের পর এক গান শ্রোতাদের মুগ্ধ করে তুলছিল। এরপর ছবিতে ব্যান্ডের সঙ্গীত পরিচালনারও দায়িত্ব নিয়েছিলেন। জনপ্রিয়তা যেন আরও দু’ধাপ এগিয়ে গেল। সেই সঙ্গে বিভিন্ন মঞ্চে অনুষ্ঠান করার চাহিদাও বাড়তে থাকে। রীতিমতো সঙ্গীত জগত নিয়ে ব‌্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। সিধুর কথায়, এ দিকে তিনি তখন শিয়ালদহের বিআর সিং হাসপাতালে ডিএনবি-র (ইন্টারনাল মেডিসিন) ডিগ্রির ছাত্র। হাসপাতালে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টে পর্যন্ত ডিউটি। এ দিকে আবার ‘ক্যাকটাস’ তখন কলকাতার পাশাপাশি গ্রামের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের শো করতে শুরু করে দিয়েছে। সিধু বললেন, ‘‘ট্রেনিং হল ৩ বছরের। তার পর পরীক্ষা।অন‌্যদিকে জোরকদমে চলছে স্টেজ শো। কিন্তু পড়াশোনার ফাঁকে এই সমস্ত কাজে আমাকে সাহায‌্য করত আমার দুই বন্ধু, রাহুল এবং জয়দীপ ।

অবশেষে ৩ ফেব্রুয়ারি উপস্থিত। ময়দানে কলকাতা বইমেলা চলছে। মেলারই এক প্রকাশনা সংস্থার স্টলে বিকালে গান হাওয়ার প্রস্তাব পেলেন। ব্যান্ডের কাছে এটি তো সুবর্ণ এক সুযোগ তা বলাই চলে। অন্য দিকে সেদিনই আবার হাসপাতালে সিধুর ২৪ ঘণ্টার ডিউটি। সিধু বললেন, ‘‘ব্যান্ডকে অনুরোধ করতেও বাকিরা রাজি হল না। ওদের দাবি ছিল, আমি ফ্রন্টম্যান। আমি না থাকলে হবেই না। হাসপাতালেও অনুরোধ করে তারিখ বদলাতে পারলাম না।’’  এরকম এক অবস্থায় এগিয়ে এসেছিলেন সিনিয়র চিকিৎসক ভাস্কর।মূলত তিনিই সাহায‌্য করে ছিলেন। কারণ বিকালে হাসপাতালে এক ঘণ্টা ভিজ়িটিং আওয়ার। তিনি ঘণ্টা তিনেকের জন্য ছাত্রকে বইমেলায় যাওয়ার অনুমতি দিলেন।

সিধুর কথায়, ‘‘স্যররা তখনও জানতেন যে, আমি গানবাজনা করি। বিকাল ৫টায় বেরোব, সন্ধ্যা ৮টায় ফিরে আসব।’’ বইমেলা থেকে ফেরার পথে পার্ক স্ট্রিট হয়ে পার্ক সার্কাস— রাস্তায় গাড়ির যানজটে তিনি। ভিড় ঠেলে হাসপাতালে পৌঁছাতে তার সময় লেগে যায় রাত সাড়ে নটা।

এরপর সিস্টারদের কাছ থেকে সিধু শুনলেন, সন্ধ্যা থেকে হাসপাতালে ৩ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন। যাঁদের মধ্যে দু’জনের অবস্থা এতটাই সঙ্কটজনক যে, তাঁদের এমার্জেন্সি ওয়ার্ড থেকে একেবারে সোজা আইটিইউ-তে পাঠানো হয়েছে। সিধু বললেন, ‘‘পুরোটাই একা হাতে সামলেছিলেন ভাস্করদা। এরপর আমি গিয়ে সমস্ত ঘটনা জানালান ও সঙ্গে মন থেকে ক্ষমা চাইলাম। উনি আমার ডিউটি সামলেছেন, তার জন্য ধন্যবাদও জানালাম।’’

 উত্তরে সিনিয়র কিন্তু কোনও প্রতিক্রিয়া দিলেন না। সিধুর কথায়, ‘‘শুধু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে’। তিনি আর কিচ্ছু বললেন না!’’

এই ঘটনার পরই নিজের কাছেও একটা খারাপ লাগা তৈরি হতে শুরু করে দেয়। কারণ এমন এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা সত্ত্বেও তাঁকে আজ এই ঘটনার সম্মুখীন হতে হল তা নিয়ে নিজের কাছে বেশ খারাপই লেগেছে। আর মনে হচ্ছিল, দু’নৌকায় পা রেখে এই ভাবে চলা সম্ভব নয়। কারণ দু’টো ভিন্ন জগৎ থেকে শুধুই ভাল দিকটা শুষে নেওয়া উচিত নয় এবং সম্ভবও নয়।’’ পরের দিনই সকাল ন’টায় ডিউটি শেষে হাসপাতাল ছাড়েন সিধু। সেই সঙ্গে চিকিৎসক হওয়ার বাসনাকেও বিদায় জানান। সিধু বললেন, ‘‘ফোন, চিঠি যা করার ছিল, সবই করে দিই। কিন্তু আমি সে-দিনের পর আর হাসপাতালে যাইনি।’’

তবে ২১ বছর আগে নেওয়া একটা সিদ্ধান্ত বদলে দিয়েছিল সিধুর জীবন। বাংলা ব্যান্ড যা হারিয়ে গিয়েছিল সকলের কাছ থেকে সেই পুরনো সংস্কৃতিতে আবার নতুন আঙ্গিকে মেলে ধরেছিলেন গায়ক সিধু। তবে সেই সময় দাঁড়িয়ে বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য হয়ে সাহসী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য নিজেরই পিঠ চাপড়ে দিতে চাইলেন সিধু। তাঁর কথায়, ‘‘সঙ্গীত আমাকে যা দিয়েছে, তা যথেষ্ট। পাশাপাশি, মানুষের যে ভালবাসা এবং সম্মান পেয়েছি, তাও আমার কাছে অনেক।”

শিল্পীর কথায়, ‘‘আমি সফল না হলেও কিন্তু আমার এমবিবিএস ডিগ্রিটা রয়েই গিয়েছে। তাই ফিরে যেতেই পারতাম। নতুনদের এটাই বলতে চাই, ফিরে আসার পথটা যেন খোলা থাকে।’’