কিছু কিছু মানুষ রয়েছেন যারা পৃথিবীতে আসেনই অমরত্ব পেতে। শারীরিক ভাবে অমরত্ব তো সম্ভব নয়, কর্মশীলতা তাঁদের বিশ্ব চরাচরে অমর করে রাখে। ইরফান খান তেমনই একজন। আজ ৭ জানুয়ারি ‘করিব করিব সিঙ্গেল’ অভিনেতার জন্মদিন। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে জীবনের সব মায়া কাটিয়ে চিরতরে হারিয়ে গিয়েছিলেন এই তারকা। প্রশ্ন ওঠে সত্যিই কি তিনি বেঁচে নেই? প্রাণখোলা হাসি, নিপাট ভাল মানুষটির মৃত্যু তো হয় না, হতে পারে না। ঠিক তেমনটাই মনে করেন ইরফানপত্নী সুতপা শিকদার। সুতপা যথার্থ অর্থেই ইরফানের অর্ধাঙ্গিনী। তাঁর সুসময়-দুঃসময় দুইয়েরই সঙ্গী। যার অসম্ভব মনের জোর বাড়িয়ে তুলেছিল দর্শককূলের প্রিয় অভিনেতার আরও কয়েকটা মাসের প্রাণবায়ু। ‘কয়েকটা মাস’-কথটি শুনতে নেহাতই খেলো। শুধু ঘন্টা, মিনিট, সেকেন্ড, দিনের বিচারে একবার হিসেব করে দেখলে ভাবনাটা বোধহয় বদলে যায়! ইরফান খানের জন্মদিবসে আজ শোনা যাক এক রূপকথার গল্প যা শুরু হয়েছিল ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার মঞ্চ থেকে।
এনএসডি’তে সহপাঠী ছিলেন ইরফান-সুতপা। ইরফানের অভিনয় ক্ষমতায় ততদিনে বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন সকলে। আর মুগ্ধ হচ্ছেন সুতপা। তাঁর মুগ্ধতার সঙ্গে অবশ্য অন্যদের মেলালে চলে না। এমনই এক মুহূর্তে দু’জনে প্রেমে পড়লেন। সিনেমা-থিয়েটারের প্রতি ভালবাসা সেই প্রেমকে পরিপূর্ণতা দিল। ইতিমধ্যে মীরা নায়ারের ‘সালাম বম্বে’তে এক পথভিখারির চরিত্র পেলেন ইরফান। সীমাহীন খুশিতে ভাসলেন দু’জন। হঠাৎ একদিন জানতে পারলেন ভিখারির চরিত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে ইরফানকে। ও মা! সেকি! ভেঙে পড়লেন তরুণ। পাশে দাঁড়ালেন তরুণী সুতপা।
তারপর চলল চুটিয়ে লিভ টুগেদার জীবন-যাপন। ঘুরতে যাওয়া, আনন্দ, থিয়েটার এ’সবের মাঝেই একদিন সুতপা বুঝলেন তাঁর গর্ভে নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটেছে। দেরি না করে বিয়ে করে ফেললেন দু’জন। অনাড়ম্বর বিয়ের সাক্ষী হল দুটি নিখাদ মন, ‘ধুত্তোর’ হল ধর্ম। ১৯৯৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বিয়ে করেছিলেন তাঁরা।
তারপর দীর্ঘ ২৫ বছরের সংসার জীবন। ছেলে বাবিলের জন্ম। ইরফান খানের এরপর ‘দ্য ইরফান’ হয়ে ওঠা। জীবনের শেষ পর্বে খান আর ব্যবহার করতেন না। পর্দার সামনে ‘মকবুল’, ‘দ্য নেমসেক’, ‘মাদারি’, ‘করিব করিব সিঙ্গেল’, ‘হায়দার’- বড়পর্দা তখন শুধুই ইরফানময়।
২০১৮ সালে জানা গেল বিরল নিউরোএন্ডোক্রাইন রোগে আক্রান্ত ইরফান খান। আবার ভেঙে পরলেন তিনি, আবারও পাশে দাঁড়ালেন সুতপা। সারাজীবন পর্দার পিছনে থেকে স্বামীকে সাহস জুগিয়েছেন এই নারী, এবারও তার অন্যথা হল না। সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখলেন স্বামীই তাঁর প্রিয় বন্ধু, স্বামী যোদ্ধা। অসম্ভব মনের জোর আর স্ত্রীর জন্যই একবার হলেও মৃত্যুতে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সেটে ফিরেছিলেন ইরফান খান। ‘আংরেজি মিডিয়াম’-এ কামব্যাক ঘটেছিল তাঁর। তারপর আচমকা ২০২০’র ২৯ এপ্রিল, চলে গেলেন সুতপার প্রিয় বন্ধু। এবার একা হলেন সুতপা। অসহায়, সাথীহারা স্ত্রীর হাত ধরতে আর এলেন না ইরফান। তবুও সুতপা বিশ্বাস করেন যে রূপকথার জন্ম হয়েছিল তাঁদের হাত ধরে তা শেষ হওয়ার নয়। তাই তো ইরফান রয়ে গিয়েছেন তাঁর অন্তরের একেবারে গোপন কক্ষটায়, যার হদিশ কেউ জানে না।