শুরুর আগে যত উপরের দিকে ইচ্ছে
বাতাস ততই হালকা হচ্ছে। শুরুতে নিঃশ্বাস নিতে সামান্য অসুবিধা হলেও পরে মানিয়ে
নিয়েছে ওরা। আসলে ছুটিতে অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে পাহাড় চষে বেড়ানোর প্ল্যান করেছিল
রূপাইরা। দলে আছে তিন জন। রূপাই, ওলি আর কিরণ। প্রথমে তিব্বত যাওয়ার প্ল্যান করেছিল। কিরণের
ইচ্ছে চমরী গাই দেখবে। কিন্তু বাজেটে কুলালো না। তাই শেষে উত্তর সিকিম যাওয়াটাই
ঠিক হয়।
সেখানে গেলে নাকি কিরণের
মনোবাঞ্ছা পূরণ হবে। সেখানে মাঠে ঘাটে চমরী গাইয়ের দেখা তো পাবেই, তার উপর
আরেকটা সারপ্রাইজও পাবে ও।
যাত্রা শুরু শিলিগুড়ির বাগডোগরা
বিমানবন্দর কিংবা নিউ জলপাইগুড়ি রেলস্টেশনের বাইরে এলেই গাড়িওয়ালাদের হাঁকাহাঁকি
কানে আসে। গ্যাংটক, কালিম্পং, কার্রিশয়ং, দার্জিলিং। প্রথমে গ্যাংটক যাবে ওরা। সেখান থেকে মাঙ্গান।
মাঙ্গান থেকে দোকপা। কিরণ কিন্তু জানে না যে ওর জন্য কী সারপ্রাইজ ঠিক করে রেখেছে
রূপাই আর ওলি।
গাড়িতে উঠেই প্রথম দোকপা গ্রামের
নাম শোনে সে। দোকপা? সেটা আবার কোথায়?
উত্তর সিকিমের পাহাড়ি গ্রাম দোকপা।
গ্যাংটকে ২ দিন ঘোরাঘুরি করে দোকপার উদ্দেশে রওনা দিয়েছে ওরা তিনজন। পাহাড়ি পথে
গাড়ির জানালা দিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কোনও তুলনা হয় না। পাইন, ফার, বার্চের
জঙ্গলে চারদিক সবুজে সবুজে মাঝে মাঝে নাম না জানা নানা রঙের ফুলের দেখা মিলছে। যত
উপরের দিকে উঠছে বাতাস তত পাতলা হচ্ছে। ওরা আছে চার হাজার মিটারেরও উঁচু এলাকায়।
গ্যাংটক থেকে ওরা যাচ্ছে মাঙ্গানের দিকে। মাঙ্গানে উত্তর সিকিমের রাজধানী। দূরত্ব
প্রায় ৬৯ কিলোমিটার।
চড়াই পথে গাড়িতে আড়াই ঘণ্টার
বেশি সময় লাগে। মাঙ্গানে পাহাড়ির ঝর্ণার সংখ্যা গুনে শেষ করা যায় না। আর সৌন্দর্য? সে তো ভাষায়
প্রকাশ করা সম্ভব নয়। মাঙ্গানে এক রাত কাটিয়ে ফের রওনা দেওয়ার কথা। কিন্তু সেখানেও
রয়েছে চমক, মাঙ্গানে পাহাড়ি মেঘেরা কাঁধ ছুঁয়ে চলে যায়। সেখানকার রিঙ্গন রিংজিন
চোলিং গুম্ফায় বৌদ্ধ সন্ন্যাসী পদ্মসম্ভবের স্মিত হাসির মূর্তি যেন পর্যটকদের বলে
ওঠেন, 'তোমার যাত্রা শুভ হোক'। মাঙ্গান থেকে থাঙ্গু হয়ে দোকপা গ্রামে যাওয়ার কথা। থাকার
ব্যবস্থা থাঙ্গুতেই করা হয়েছে। সেখানকার চূড়ান্ত ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচতে ওঁদের
তৈরি মশলাদার চা খাওয়া খুব প্রয়োজন। আর খেতে হবে সেখানকার স্থানীয় পানীয়
টোঙ্গবা।থাঙ্গু থেকে দোকপা গাড়িতে যাওয়া যায়। তবে পায়ে হেঁটে বা খচ্চরে পিঠে চড়ে
যাওয়ার মজাই আলাদা। পথে নজরে পড়বে অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য (যা কিনা পকিছুক্ষণ
পর পরই চেহারা পরিবর্তন করে), পাহাড়ি পোকামাকড় আর গাছপালা। প্রকৃতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে
পরিবর্তিত হয় এখানকার আবহাওয়া। কখনও রোদ,
কখনও মেঘ আবার কখনও ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। এসব
পেরিয়ে অবশেষে পৌঁছন গেল দোকপা গ্রামে। গ্রামে সেদিন উত্সব। পরবের নাম 'দুকপা সে শি
উৎসব'।সারনাথে গৌতমবুদ্ধের প্রথম পাঁচ শিষ্যকে দীক্ষা দেওয়ার দিনকে স্মরণে
রেখে পালিত হয় এই পরবটি। তিব্বতি ক্যালেন্ডারের ষষ্ঠ মাসের চতুর্থ দিনে শুরু হয় এই
'দুকপা সে শি পরব'। পরবের প্রধান আকর্ষণ চমরী গাইযের দৌড় প্রতিযোগিতা।
দোকপা গ্রামে ঢোকার সময়ই চমরী গাইয়ের পাল দেখে আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিল কিরণ। আরে
এতগুলো চমরী গাই একসঙ্গে? শুধু চমরী গাই নয়,
ওদের সঙ্গে ছিলেন একদল বাজনাওয়ালা, আর কয়েকজন
স্থানীয় আদিবাসী। 'দুকপা সে শি উৎসবে'র চমরী গাইয়ের দৌড় প্রতিযোগিতা বিশ্ববিখ্যাত। তবে
বিদেশিরা যতটা এসব নিয়ে খোঁজ খবর রাখেন ভারতীয়রা ততটা রাখেন না।