রাউরকেল্লার মানুষ জনের মননে হকি কতটা গভীরে গেঁথে রয়েছে তা বোঝা গেল বিশ্বকাপের উদ্বোধনী দিন। বিশ্বকাপ হকির উদ্বোধন হয়েছে ভুবনেশ্বরের কলিঙ্গ স্টেডিয়ামে কিন্তু মানুষের উন্মাদনা, জনপ্লাবন এবং টিকিটের হাহাকারের বিচারে ভারতের যে কোনও বড় শহরকে টেক্কা দেবে রাউরকেল্লা।
ঘড়ির কাঁটা তখন জানান দিচ্ছে দুপুর সাড়ে তিনটে। হঠাৎই গাড়ি করে যাওয়ার সময়ে নজরে পড়ল স্টেডিয়াম থেকে প্রায় দেড় কিমি দূরে এসে পড়েছে একটি লাইন। আরও কিছু যাওয়ার পর পরিষ্কার হয়ে গেল চিত্রটা। এই লাইন সেই সকল হকি প্রেমীদের, হকি অন্তঃপ্রাণ সমর্থকদের যাঁদের জন্যই মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক রাতারাতি বিশ্বের বৃহত্তম বিরসা মুণ্ডা হকি স্টেডিয়াম করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন প্রায় ২৬০ কোটি টাকা খরচ করে। এ দিন শহরের সব রাস্তাই এসে মিলছিল স্টেডিয়াম সংলগ্ন রাস্তায়। গোটা শহরের ঠিকানা একটাই- বিরসা মুণ্ডা স্টেডিয়াম।
লাইনে দাঁড়ানো কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলে যা জানতে পারলাম তাতে নিজের দীর্ঘ ক্রীড়া সাংবাদিকতায় এমন দৃশ্যের সম্মুখীন হয়েছি বলে মনে পড়ে না। এই মানুষগুলো দুপুর সাড়ে এগারোটা থেকে দাঁড়িয়ে রয়েছেন লাইনে, অথচ কারোর মুখে বিন্দু মাত্র অসন্তোষের ছাপটুকুও নেই। যেন এক মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য দাঁড়িয়ে প্রত্যেকে, যতক্ষণই দাঁড়াতে হোক শেষটাতো সেই মধুরই। পঞ্জাবকে বলা হয় ভারতীয় হকির আঁতুর ঘর। ঠিকই, ভারতীয় হকির কৌলিন্য এবং গড়িমা বারবার বাড়িয়েছে পঞ্জাব এবং তার ভূমিপুত্ররা। কিন্তু আধুনিক ভারতে হকির তীর্থক্ষেত্র যদি ওড়িশাকে বলা হয় তা হলে একটুও রং চড়িয়ে বলা হবে না। কলকাতায় ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের ডার্বিকে ঘিরে এই উন্মাদনা লক্ষ্য করেছি বহু বার যেখানে শিলিগুড়ি, দীঘা, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর কিংবা কালিম্পং থেকে মানুষ রাতের ট্রেনে কলকাতায় এসে রাত কাটিয়েছেন ময়দানে সকাল থেকে টিকিটের লাইনে দাঁড়াতে হবে বলে। এঁনাদের টিকিটের লাইনে দাঁড়াতে হয়নি কিন্তু স্টেডিয়ামের গেট খেলার জন্য তাঁদের এই দীর্ঘ সাড়ে চার ঘণ্টা ঠাঁয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার নমুনা বুঝিয়ে দেয় ওড়িশা এবং নির্দিষ্ট ভাবে রাউরকেল্লা-ই ভারতীয় হকির শেষ ঠিকানা হতে পারে। যদি হকি বিশ্বকাপ আয়োজন করতে হয় তা হলে এই মানুষগুলোর জন্যই এই শহরকে বেছে নেওয়া প্রয়োজন। বিরসা মুণ্ডা স্টেডিয়ামটি তৈরি হয়েছে শহরের এক প্রান্তে। তাই ভিতরের দিকে থাকা মানুষদের আসতে হয়েছে আগে থেকেই।
ক্রিকেট-ফুটবলের ভিড়ে এক সময়ে দেশের শীর্ষ স্থানে থাকা এই খেলার থেকে মুখ ফিড়িয়েছেন বহু মানুষ। দেশের অন্যান্য প্রান্তে মাঠ ভড়াতে সংগঠকদের কালঘাম ছুটে যায়। ঐতিহ্যশালী বেটন কাপও আজ সমর্থকদের অভাবে নিজস্ব কৌলিন্য হারিয়েছে। তবে ওড়িশায় যে এই খেলা উত্তরোত্তর মানুষের অন্তরে স্থায়ী জায়গা করে নিচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
রাউরকেল্লা এবং তাঁর সংলগ্ন এলাকার মানুষ সত্যিই যে হকি খেলাটাকে ভালবাসে তা বোঝা যায় তাঁদের এই উন্মাদনা থেকে। সন্ধ্যা ৭'টা থেকে স্পেনের বিরুদ্ধে ম্যাচ ছিল ভারতের। তার আগে খেলা ছিল ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসের। শুধু ভারতের খেলাই যদি দেখতে হতো তা হলে বিকেলেই মাঠে আসতে পারতেন সমর্থকেরা কিন্তু তাঁরা চেয়েছিলেন প্রথম ম্যাচটি দেখতেও তাই এত কষ্ট সহ্য এবং তার ফল সরূপ দেশের জয় স্বচক্ষে দেখা তাও আবার বিশ্বকাপের মঞ্চে। এ দিন ভারতের ম্যাচের সময়ে মাঠে উপস্থিত হয়েছিলেন ওড়িশার ক্রীড়াপ্রেমী মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক।
মুখ্যমন্ত্রীর অনুিপ্রেরণায় সারা শহর সেজে উঠেছে আলোর রোশনাইয়ে। সর্বত্র বিরাজ করছে নানান আলোর রকমারি সাজ। পার্ক স্ট্রিট যে ভাবে সেজে ওঠে বড় দিন এবং নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে সেই ভাবেই হাজার ওয়াটের আলোর ঝলকানিতে উজ্জ্বল রাউরকেল্লা। আলোর রোশনাইয়ে বাইরে সেজে ওঠা শহরটির মতো মাঠের মধ্যেও ছিল আঁতোশবাজির ঝলকানি। অতীতেও হকি বিশ্বকাপ আয়োজিত হয়েছে ওড়িশায়।
বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই ভারতীয় দল জয়ের দেখা পেয়েছে। স্পেনকে ২-০ গোলে পরাজিত করেছে ভারত। ভারতীয় দলের এই ম্যাচে দাপট ছিল শুরু থেকে। তবুও পাঁচটি পেনাল্টি কর্নার পেয়েও তা কাজে লাগেতে পারেনি হরমনপ্রীত সিং-এর দল। গ্রাহাম রিডের প্রশিক্ষণাধীন দলের হয়ে দুইটি গোল করেন অমিত রোহিদাস এবং হার্দিক সিং। অমিত রোহিদাস রাউরকেল্লার ছেলে এবং নিজের জন্মভূমিতেই করলেন হকি বিশ্বকাপের ২০০তম গোল।
Soigiougs
Mar 09, 2023 12:05 [IST]