রাত পোহালেই মহালয়া। পিতৃপক্ষের অবসান হয়ে দেবীপক্ষের সূচনা, মায়ের আগমনের
এ যেন আনুষ্ঠানিক বার্তা বহনের তিথি। বাঙালির মহালয়া যাঁকে ছাড়া অসম্পূর্ণ তিনি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ
ভদ্র। হলফ করে বলা যায় শ্রদ্ধেয় এই মানুষটি না থাকলে বঙ্গজনের মহালয়ার ভোর বড় বিস্বাদ
ঠেকতো। সারা বছর অযত্নে ঘরের কোণে পড়ে থাকা রেডিওর আজ গা ঝাড়া দিয়ে উঠে আসার দিন, অধিকাংশ
বাড়িতে এই একদিনের বিশেষ অতিথি সে।
‘আশ্বিণের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির,
ধরনীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা,
প্রকৃতির অন্তরাকাশে জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা’- বাঙালির রন্ধ্রে
রন্ধ্রে জড়িয়ে রয়েছে মহিষাসুরমর্দিনী এবং এই কণ্ঠ। মহালয়ার প্রাক্কালে তাই আমাদের প্রণম্য
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গল্প বললেন তাঁর নাতি সায়ম ভদ্র।
মহিষাসুরমর্দিনী
এবং আপনার দাদু- একত্রিত হয়ে হয় কিংবদন্তি, সেই সম্পর্কে কী বলবেন?
সায়ম: আমি দাদুর সঙ্গে
বসে বেশ কয়েকবার মহালয়া শুনেছি। দাদু কিন্তু কোনওদিন মূর্তিপুজোয় বিশ্বাসী ছিলেন না।
বাড়িতেও পুজো আর্চা করতেন না। মহিষাসুরমর্দিনী খুব ভাল করে শুনলে বুঝতে পারবে কিছু
কিছু জায়গায় দাদুর কণ্ঠ অবরুদ্ধ হয়ে আসে, উচ্চারণ অস্পষ্ট হয়, মনে হয় যে কোনও সময় কেঁদে
ফেলবেন। আমি যখন দাদুর সঙ্গে বসে শুনতাম তখন তো আর লাইভ হত না, রেকর্ডিংই চালানো হত।
লক্ষ্য করতাম রেডিওতে স্তোত্রপাঠে যখনই এই অংশগুলি আসে তখন দাদু অঝোরে কাঁদেন। আমি
একবার কৌতুহল মেটাতে জিজ্ঞাসাও করেছিলাম এই বিষয়ে। উত্তরে দাদু বলেছিলেন স্তোত্রপাঠ
করতে করতে কিছু জায়গায় দাদুর মনে হত দেবী বুঝি স্বয়ং সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। একটা অলৌকিক
শক্তি অনুভব করতে পারতেন উনি।
চন্ডীপাঠে
অধিকার ব্রাহ্মণে, প্রথা ভেঙেছিলেন বীরূপাক্ষ- সেই সময় কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এতে?
সায়ম: আমরা ব্রাহ্মণ নই,
কায়স্থ। ফলে আলোড়ন তো উঠবেই। রেডিও অফিসে গিয়ে সেই সময়ের ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের কিছু
নেতৃস্থানীয় মানুষ রীতিমতো প্রশ্ন করেছিলেন কেন কায়স্থর ছেলেকে দিয়ে স্তোত্রপাঠ করানো
হচ্ছে। তাতে শ্রদ্ধেয় বাণীকুমার কোনওরকম আমল দেননি। ওনারা বিন্দুমাত্র সংকীর্ণ মনোভাবাপন্ন
ছিলেন না।
মহিষাসুরমর্দিনী
তৈরি হল কীভাবে?
সায়ম: আমি যেটা দাদুর
কাছে শুনেছি মহিষাসুরমর্দিনী তৈরি হওয়ার মাস তিনেক আগে বসন্ত ঋতুর উপরে একটি অনুষ্ঠান
হয়েছিল যেটা খুব হিট হয়। এতটা লম্বা প্রোগ্রাম ছিল না সেটি অবশ্য। এই বসন্তের উপর ব্রডকাস্ট
হওয়া অনুষ্ঠানেও গান ছিল, স্তোত্রপাঠ ছিল। এই অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তার কথা মাথায় রেখে
অল ইন্ডিয়া রেডিওর তিন মহারথী বাণীকুমার, পঙ্কজ কুমার মল্লিক এবং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র
এঁদের মনে হয়েছিল এমন একটি অনুষ্ঠান দুর্গাপুজোর প্রাক্কালে করলে ভাল হয়।
মহানায়ক
উত্তম কুমার আপনাদের বাড়িতে সত্যিই এসেছিলেন বীরূপাক্ষের থেকে অনুমতি নিতে?
সায়ম:
উত্তম
কুমার মহিষাসুমর্দিনী প্রসঙ্গে আসেননি। উত্তম কুমার ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কথোপকথন
হয়েছিল টেলিফোনের মাধ্যমে। আসলে মহানায়ককে আগে অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে প্রস্তাব দেওয়া
হয়েছিল দুর্গাদুর্গতিহারিণীর জন্য। উনি কিন্তু দাদুর অনুমতি ছাড়া অনুষ্ঠানটি করতে চাননি।
আসলে তখনকার দিনের মানুষের মধ্যে একটা সৌজন্যবোধ ছিল যার আজ বড়ই আকাল। উত্তমবাবু জিজ্ঞাসা
করেছিলেন যে এই প্রস্তাব ওনার গ্রহণ করা উচিত কিনা? ‘বীরেনদা’র অনুমতি না পেলে
তিনি মোটেই রেডিওর প্রস্তাব গ্রহণ করবেন না। দাদু কিন্তু বাধা দেননি। উনি বরাবরই নতুনদের
জায়গা করে দেওয়ার পক্ষপাতি ছিলেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই দাদু বলেন, তিনি খুব খুশি হবেন
উত্তম কুমার অনুষ্ঠানটি করলে।
রেডিও
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিলেন দুর্গাদুর্গতিহারিণীর কথা?
সায়ম: রেডিও কর্তৃপক্ষের
বাণীকুমার, পঙ্কজ কুমার মল্লিক এবং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে জানানোর মতো সৌজন্যবোধটুকুও
ছিল না। ১৯৭৬ সালের মহালয়ার ভোরে মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠিত হবে না। দাদু সম্পূর্ণ বিষয়টি
জানতে পারেন অন্য জায়গা থেকে। পরে উত্তম কুমার জানান।
সেদিনের
মহালয়ার ভোরের চিত্রটি কেমন ছিল?
সায়ম: ১৯৭৬ এর মহালয়ার
ভোর, সকলে বসে আছি। মন অবশ্যই খারাপ কারণ মহিষাসুরমর্দিনী বাজানো হবে না রেডিওতে। সেই
সময় উত্তম কুমার তো মধ্যগগনে। তাই তাঁর মহালয়া কেমন হয় সেই উৎসাহও কিছু কম ছিল না।
আমি, দাদু, ঠাকুমা, আমার বড়পিসি সবাই বসে আছি। ভোর চারটে বেজে পাঁচ মিনিট নাগাদ আমাদের
কালো ফোনটা প্রথম বেজে উঠল। ফোনটি করেছিলেন নাট্যকার মন্মথ রায়। দাদু দেখলাম দু’মিনিট কথা বলেই রেখে
দিলেন। সেদিন বিশিষ্ট নাট্যকার সরাসরি দাদুকে জিজ্ঞাসা করেন, “বীরেন তুমি এটা হতে দিলে
কীভাবে?” সকলেই ভেবেছিলেন দাদুকে জানিয়েই রেডিও কর্তৃপক্ষ নতুন অনুষ্ঠান করেছে। সেদিন
একের পর এক ফোন এসেছিল, একসময় রিসিভার পাশে নামিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম আমরা।
পরে
রেডিও কর্তৃপক্ষ ক্ষমা চেয়েছিল?
সায়ম:
না,
ক্ষমা কেউ চায়নি। কিন্তু একইসঙ্গে এটাও বলতে হয় মহিষাসুরমর্দিনীর জায়গায় দুর্গাদুর্গতিহারিনী
সম্প্রচারিত হওয়াই এমনই জনরোষ পড়ল অল ইন্ডিয়া রেডিওর ওপর যে প্রথা ভেঙে তারা সেই বছরই
ষষ্ঠীতে মহিষাসুরমর্দিনী ব্রডকাস্ট করতে বাধ্য হলেন।
সারা
জীবন যে মানুষটা রেডিওকেই দিয়ে দিলেন, তার জন্য কিছুই করল না বেতার কর্তৃপক্ষ?
সায়ম: কিছুই করেননি। দাদুর
পেনশনের ব্যবস্থাটা পর্যন্ত করা হয়নি। এটা ছিল দাদুর ক্ষোভের জায়গা। আসলে দাদু কোনওদিন
তো অল ইন্ডিয়া রেডিওর কর্মী সেইভাবে ছিলেন না। উনি ছিলেন চুক্তিভিত্তিক কর্মী। প্রতি
বছর এই চুক্তির নবীকরণ হত। বারবার প্রস্তাব আসলেও দাদু কখনও পার্মানেন্ট এমপ্লয়ি হতে
চাননি। আসলে দাদুর একটা দৃঢ় ধারণা ছিল, পার্মানেন্ট এমপ্লয়ি হলে চিরকাল রেডিও স্টেশন
এবং কেন্দ্রের আমলাদের কথায় উঠতে বসতে হবে। যেটা দাদুর মতো একজন ক্রিয়েটিভ মানুষের
পক্ষে কখনওই সম্ভব ছিল না।
শুনেছি
গার্স্টিন প্লেসের পুরনো রেডিও অফিসের ভুতেরাও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে ভয় পেত, কিছু
বলবেন এই বিষয়ে?
সায়ম: এই বিষয়ে জানি কিছু
মজার ঘটনা। কিন্তু সঠিক তো জানি না। তাই এ বিষয়ে না বলাই ভাল। তবে তোমাকে আমি উত্তম
কুমার সম্পর্কে একটা মজার ঘটনা বলতে পারি।
শুনি?
সায়ম: উত্তম কুমার একবার
আমাদের বাড়িতে এসেছেন ওনার ছেলের অন্নপ্রাশনে দাদুকে নিমন্ত্রণ করবেন বলে। একতলায় দাঁড়িয়ে
‘বীরেনদা’ ‘বীরেনদা’ বলে ডাকছেন। এদিকে দুপুরবেলা, সকলেই দিবানিদ্রা দিচ্ছে বাড়িতে।
ডাক শুনে আমার ছোট পিসি যিনি তখন খুবই ছোট, নেমে যান দোতলার সিঁড়ি বেয়ে। উত্তম কুমার
কে তাও তাঁর তখন জানা নয়। মহানায়ক বাচ্চা মেয়েটিকে দেখে জিজ্ঞাসা করেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ
ভদ্র বাড়িতে আছেন কিনা। ছোট পিসি জানান দাদু বাড়িতে নেই। তখন উত্তম কুমার ছেলের অন্নপ্রাশনের
কার্ড বের করে পিসির হাতে দিয়ে বলেন যে বাবাকে বলে দিও উত্তম এসেছিল। ওনার ছেলের অন্নপ্রাশন,
বীরেনদা যেন অবশ্যই আসেন। তখন আমার ছোট পিসির অমর উক্তি, “এরকম উত্তম টুত্তম তো অনেকেই
আসে বাড়িতে। পুরো নামটা না বললে ঠিক বলতে পারব না।” ইতিমধ্যে আমার এক জেঠু নিচে নেমে গিয়েছিলেন।
তিনি গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন। পরে তাঁর কাছ থেকেই এই ঘটনা জানতে পারেন বাড়ির লোক।
শোনা
যায় মহালয়ার ভোরে ধুতি উত্তরীয় গায়ে দিয়েই বাড়ি থেকে স্টুডিওতে যেতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ
ভদ্র, এটা সত্যি?
সায়ম: হ্যাঁ, হ্যাঁ দাদু
একদম ধোপদুরস্ত হয়েই বেরোতেন বাড়ি থেকে। অল ইন্ডিয়া রেডিও কর্তৃপক্ষ আগেই গাড়ি পাঠিয়ে
দিত। তবে এই যে অনেকে বলেন না যে মহিষাসুরমর্দিনীর আগে সকলে গঙ্গাস্নান করতেন, মেয়েরা
লাল পাড় শাড়ি, ছেলেরা ধুতি পঞ্জাবী পরতেন, এগুলো আমার মনে হয় কিছুটা কিংবদন্তি। আসলে
যখন কেউ বা কোনও বিষয় ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে যায় তখন তো তাঁকে ঘিরে কিংবদন্তি তৈরি হবেই।
অনেকটা
সময় দিলেন, অসংখ্য ধন্যবাদ
সায়ম: (হেসে) ধন্যবাদ
তোমাকেও।