যখনই ভারতের বড় বড় চলচ্চিত্র পরিচালকদের কথা আসে, তখনই অবধারিতভাবে এসে
যায় সত্যজিৎ রায়ের নাম। ১৯৫৫ সালে তিনি তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন যার নাম
ছিল 'পথের পাঁচালী'। এই ছবির শুটিং করতে আড়াই বছর সময় লেগেছিল। একইসঙ্গে ছবিটির একটি
ছোট দৃশ্যের শুটিং করতে বেশ কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে। এই নিবন্ধে, আমরা আপনাকে
পথের পাঁচালী সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য দেব। আপনি জানতে পারবেন সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র
নির্মাণের মাত্রা কী ছিল।
‘পথের পাঁচালী’ সিনেমাটি ঔপন্যাসিক
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১৯২৯ সালে রচিত একই নামের বাংলা উপন্যাসের রূপান্তর।
আজ ভিএফএক্স, ক্রোমা এবং অন্য বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে চলচ্চিত্র তৈরি করা হচ্ছে,
তবে আগে এই সমস্ত কৌশল সহজে পাওয়া যেত না। এ ছাড়া আজকের মতো চলচ্চিত্রে কাজ করা অভিনেতাদের
সংখ্যাও আহামরি তো ছিল না। তাই সত্যজিৎ রায় যখন পথের পাঁচালী নির্মাণের সিদ্ধান্ত
নেন সেই সময়ে ছবিটি সম্পূর্ণ হবে কি না তা নিয়ে পরিচালক মহাশয়েরই নিদারুণ সন্দেহ
ছিল। কারণ সেই সময় তিনি একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করছেন। সেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে সিনেমার
শুটিং করছেন।
সিনেমা তৈরির জন্য দরকার ছিল টাকার। সত্যজিতের তখন এত আর্থিক সংস্থান কোথায়!
তাই যখনই টাকা ফুরিয়ে যেত, তখনই তিনি শুটিংয়ের কাজ বন্ধ করে দিতেন।
ছবির প্রধান চরিত্র অপু নামের একটি বছর ছয়েকের ছেলে। তাকে খুঁজে পাওয়াও
সহজ ছিল না। একদিন সত্যজিৎ রায়ের স্ত্রী পাশের বাড়ির বারান্দায় একটি ছেলেকে দেখতে
পান, যে অপুর চরিত্রে অভিনয়ের জন্য উপযুক্ত ছিল। পথের পাঁচালীর অপুর জন্য তাকে বেছে
নেওয়া হয়েছিল। সেই ছেলেটির নাম ছিল সুবীর ব্যানার্জি। আড়াই বছর ধরে যে ছবিটির কাজ
চলবে সে সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না সত্যজিতের।
ছবিটির একটি দৃশ্যের জন্য কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হয়েছিল। আসলে, ছবিটিতে
একটি বড় দৃশ্য ছিল, যেটি কলকাতা থেকে ৭০ মাইল দূরে পালসিট নামে একটি গ্রামে শুট করা
হয়েছিল। যখন তিনি স্থানটি দেখতে যান তখন সেখানে কাশফুলে ভরা চারদিক। দৃশ্যটি ছিল এমন
যে অপু দুর্গা প্রথমবার ট্রেন দেখতে পেয়েছে। দুজনেই দৌড়াচ্ছে। এই গোটা দৃশ্যের শুটিং
একদিনে সম্ভব ছিল না। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অর্ধেক দৃশ্যের শুটিং সম্ভব হয়েছিল।
শিল্পী থেকে পরিচালক সকলে সাত দিন পর যখন সেখানে পৌঁছালেন, তখন আর ওই জায়গায় কাশফুল
ছিল না। পশুরা সেই সব ফুল খেয়ে ফেলেছিল। ওই অবস্থায় শুট করা হলে প্রথম অংশের সঙ্গে
শটের অংশ মিলত না। তাই সেই দৃশ্যটি পরের বছর শরৎকালে আবার শ্যুট করা হয়েছিল যখন চারদিক
কাশফুলে ভরা।
আরও পড়ুন: Sabyasachi Chakraborty: 'আমি সিনেমা ছেড়ে দিচ্ছি', অভিনয় জগত্ থেকে অব্যাহতি নিতে চলেছেন সব্যসাচী চক্রবর্তী
আরও পড়ুন: মেহমুদের মতো বন্ধু না থাকলে আর ডি বর্মনের মতো সঙ্গীতজ্ঞকে কি আদৌ পেত বিশ্ব
পাহাড়প্রমাণ সমস্যাদের অতিক্রম করে সত্যজিৎ রায় তাঁর প্রথম সিনেমা পথের
পাঁচালি নির্মান করেছিলেন। যে উপন্যাসকে কেন্দ্র করে এই ছবি সেখানে অপু ও দুর্গার একটি
পোষা কুকুরের কথাও বলা হয়েছে। এর জন্য বোড়াল গ্রাম থেকেই একটি কুকুর নিয়ে যাওয়া
হয়েছিল। বেশ কিছুদিনের মধ্যে সত্যজিৎ টিমের সঙ্গে তার খুব বন্ধুত্ব হয়ে যায়। কুকুরটির
নাম ছিল ভুলো। ভুলোর সঙ্গে সিনেমার কিছু শুটিং হয়েছিল, বাকি শুটিং করতে তিনি যখন ছ’মাস পর বোড়ালে আসেন
তখন ভুলো মারা গিয়েছে। এরপর জানা গেল, ভুলোর মতো গ্রামে আর একটি কুকুর রয়েছে, যেটি
দেখতে হুবহু ভুলোর মতো। এরপর একই কুকুরের সঙ্গে বাকি দৃশ্যের শুটিং করা হয়।
ছবিতে একটি দৃশ্য ছিল যে শ্রীনিবাস নামে এক মিষ্টি বিক্রেতা যিনি ঘোরাঘুরি
করে মিষ্টি বিক্রি করেন। কিছুটা শুটিং করার পর সত্যজিৎ চলে যান। তারপর কয়েক মাস পরে
যখন টাকা হাতে আসে তখন মানিকবাবু আবার শুটিংয়ের জন্য আসেন। কিন্তু এসে জানতে পারেন
যে শ্রীনিবাস মারা গেছেন। এবার সমস্যা দেখা দিল যে শ্রীনিবাসের মতো দেখতে লোক কোথায়
পাওয়া যাবে। অনেক খুঁজে একজনকে পাওয়া গেছে, যাকে দেখতে শ্রীনিবাসের মতো নয়, কিন্তু
শারীরিক গঠন তাঁর মতো। তাই তিনিই শেষ পর্যন্ত শ্রীনিবাসের ভূমিকায় অভিনয় করে সত্যজিৎ
রায়কে বাঁচান।
একই সঙ্গে সিনেমায় বৃষ্টির দৃশ্যের শুটিংয়েও নানা সমস্যা দেখা দিয়েছিল।
টাকার অভাবে শুটিং করা সম্ভব হয়নি। বর্ষা এল আর গেল, কিন্তু শুটিং হল না। টাকা যখন
এল তখন অক্টোবর মাস। সত্যজিৎ রায়ের আশা ছিল আকাশে কালো মেঘ থাকলে শুটিং হবে। দীর্ঘ
প্রতীক্ষার পর অবশেষে সেই দিন এল। সম্পূর্ণ হল শুটিং।