মহালয়ার আর হাতে গোনা কয়েকদিন বাকি। দেবীপক্ষের সূচনায় ‘মহিষাসুরমর্দিণী’ দিয়ে শুরু হয় শারদীয়ার। দুর্গাপুজো সকলের জন্য আনন্দ বয়ে নিয়ে আসলেও মহিষাসুরের বংশের জন্য আনে শোক। আগমণীর আগমনে যখন চারদিক মাতোয়ারা তখন অসুরবংশীয় আদিবাসীরা পালন করেন শোক।

আদিবাসীদের লোককথা অনুযায়ী আর্য দেবী দুর্গা বধ করেছিলেন অনার্য মহিষাসুরকে। তাও সম্পূর্ণ ছলনার মাধ্যমে। হাজার হাজার বছর পেরিয়ে গেলেও এই ক্ষত তাঁদের বুকে আজও তাজা। তাই দুর্গাপুজোর আনন্দে মাতে না এই উপজাতি।

পশ্চিমবঙ্গ ঝাড়খন্ড ও বিহারের তিনটি রাজ্যে মূলত ‘অসুর’ উপজাতির বাস।  এরা মহিষাসুরের সম্মানে যে স্মরণসভার আয়োজন করে তার নাম ‘মহান অসুর সম্রাট হুদুড় দুর্গা স্মরণ সভা।’ 

আদিবাসী সমাজে মহিষাসুরের পরিচয় ‘হুদুর দুর্গা’ বলে। কেন এমন নাম? আদিবাসীদের মতে দুর্গা আসলে সম্রাট মহিষাসুরেরই নাম। গবেষক শরদীন্দু উদ্দীপন বলেছেন ‘হুদুড়’ শব্দের অর্থ হল প্রবল ঝড় বা বজ্রবিদ্যুতের আওয়াজ। আদিবাসীদের বিশ্বাস মহিষাসুরের শক্তি ছিল বজ্রসম। আর দুর্গা অর্থে দূর্গের রক্ষক। সব মিলিয়ে এমন ব্যক্তি যিনি শক্তিশালী কোনও এক দূর্গকে রক্ষা করে চলেছেন। সেই মানুষটিকে হত্যা করেছেন কোনও এক গৌরবর্ণা নারী।

আরও পড়ুন: বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কণ্ঠস্বরই ইউএসপি, মহানায়কের হার সেখানেই

আরও পড়ুন: পুজোয় সময় কম খরচে বেড়ানোর দুর্দান্ত 'দেশি' অপশন

সেই গৌরবর্ণা নারীর সঙ্গে দেবী দুর্গার মিল। অর্থাৎ সে আর্যদের প্রতীক। আর কৃষ্ণবর্ণ, পুরু গোঁফের মহিষাসুর অনার্যদের প্রতীক। অনার্য মহিষাসুরকে বধ করতেই আর্যরা এক নারীকে পাঠান। কালে কালে তিনিই পুজিত হন দেবী দুর্গা রূপে।

দুর্গাপুজোর সময় অরন্ধন করে, নিজেদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে মহিষাসুরকে স্মরণ করেন আদিবাসীরা। দুর্গাপুজোর মন্ত্র, শংখধ্বনি, উলুধ্বনী, ঢাকের আওয়াজ যাতে তাঁদের কান পর্যন্ত না পৌঁছায় সেই জন্য বন্ধ রাখা হয় দরজা জানলা। পুরুষরা নারী যোদ্ধার ছদ্মবেশ পালন করে ক্রন্দনের সুরে গান করেন। অশৌচ পালন করেন, ভুয়াং বাদ্যযন্ত্র নিয়ে নাচ করেন। বর্তমানে আদিবাসী সমাজ ষষ্ঠী, সপ্তমী থেকেই  শোক পালন শুরু করেন। দাসাই, ভুয়াং এগুলো চলতে থাকে পাড়ায় পাড়ায়। আর দশমীর দিন হয় বড় অনুষ্ঠান।

উত্তর প্রদেশের বুন্দেলখন্ডে, মহীশুর বা মাইসোর শহর, খাজুরাহোর মন্দিরের মহিষাসুরের চিত্র পাওয়া গিয়েছে। দলিত সম্প্রদায়ের সাহিত্য সংক্রান্ত গবেষক প্রমোদ রঞ্জন আবার বলেছেন চাউকা নামে একটি জায়গা রয়েছে যেখানে মহিষাসুর কখনও ভৈঁসাসুর, কোথাও মাইকাসুর আবার কোথাও মহিষাসুর নামেই পুজিত হন।  দলিত সম্প্রদায় মূলত মহিষাসুরকে গরু, মোষের মতো গৃহপালিত পশুর রক্ষাকর্তা বলে মনে করেন। তবে বর্তমানে গবেষকরা বলছেন মহিষাসুর নির্দিষ্ট কোনও একজন ব্যক্তি নন। সম্ভবত এটি একটি উপাধি যা যুগের পর যুগ ধরে বহন করে আসছেন আদিবাসী সম্প্রদায়।