মহালয়া মানেই পিতৃপক্ষের অবসান, দেবীপক্ষের সূচনা। ঠিক যেমন শিউলি
ছাড়া শরতের পূর্ণতা নেই, কাশফুল ছাড়া আগমনীর আগমন অসম্পূর্ণ, তেমনই বেতারে
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চন্ডীপাঠ, দূরদর্শনে মহিষাসুরমর্দিনী ব্যতিত বাঙালি
পরিপূর্ণতা পায় না। মহিষাসুরমর্দিনী বলতে দেশে-বিদেশে থাকা প্রতিটি বঙ্গজনের মননে
আসে একটিই মুখ। সেই মুখের আদল পানপাতার মতো, তাতে টানা টানা চোখ, টিকালো নাক,
দশভূজার সমস্ত রূপ বিদ্যমান তাঁর মধ্যে। নয়ের দশকে যারা জন্ম নিয়েছেন তাঁদের মনে
রঙীন হয়ে চিরকালের জন্য রয়ে গিয়েছেন সাদা-কালো দূরদর্শনের মহিষাসুরমর্দিনী। তাঁর
পরিবর্তে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বড় নাম এলেও এই বঙ্গললনার পরিপূরক হয়ে উঠতে
পারেননি কেউই। উমাকে এত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেনই বা কে! ঠিকই ধরেছেন, কথা
হচ্ছে ডক্টর সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে।

বাংলার ঘরের মেয়ে আজ প্রবাসী, স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখের বাস সেখানে।
গড়েছেন নিজস্ব ড্যান্স অ্যাকাডেমি। প্রবাসের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃত্যে অর্জন
করেছেন ডক্টরেট ডিগ্রি। বড় সাধ হয়েছিল মহালয়ার আগে তাঁর সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার।
মুঠোফোনের দৌলতে সেই সাধ পূরণ হতে বেশি সময় লাগেনি। বাঙালির উমা সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকে SportsnScreen- এর আমি মৌমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুনলাম বহু না জানা কথা। শুনে মুগ্ধ হলাম।
এত বছর পরেও মানুষ
আপনাকে একইভাবে মনে রাখছে, কেমন লাগে ভাবলে?
সংযুক্তা: অবশ্যই খুব ভাল লাগে। আমি মনে করি ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্যা বলেই আজ এত
বছর পরেও মানুষের মনে রয়েগিয়েছি আমি। আমাদের পরবর্তী জেনারেশন যখন দূরদর্শনে আমার
অভিনীত মহিষাসুরমর্দিনী নিয়ে কথা বলে তখন একজন পারফর্মিং আর্টিস্ট হিসাবে আমার মনে
হয় এর থেকে বড় পুরস্কার বোধহয় আর কিছু হয় না। এই যে সব বয়সের মানুষ সেদিনের
মহিষাসুরমর্দিনীকে ফিরে দেখছে এটাই তো দুর্দান্ত প্রাপ্তি।
নাচের শুরু একদম
ছোট থেকেই?
সংযুক্তা: শুনেছি আড়াই বছর বয়স থেকে প্রথম নাচ শিখছি আমি। স্কুলে ভর্তির আগে
নাচের স্কুলে ভর্তি হওয়া আমার। আসলে আমার জেঠতুতো দিদি গান শিখতে যেতেন, আমিও
বায়না করতাম ওর সঙ্গে যাব বলে। দিদির সঙ্গে যেতে যেতে দেখতাম একটা ঘরে নাচের ক্লাস
হচ্ছে, আর একটি ঘরে গানের ক্লাস। নাচের স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেই আমি ওখানে পারফর্ম
করতাম খুব উৎসাহের সঙ্গে। তখন সেখানকার শিক্ষিকারাই মাকে বলেন ভর্তি করে দিতে। সেই
শুরু।
দূরদর্শনে আসা
কীভাবে
সংযুক্তা: নাচের স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, দূরদর্শনে
শিশুদের নানারকম অনুষ্ঠান করতাম। পরবর্তীতে আমি যখন কলামণ্ডলমে ভর্তি হই তখনও
বিভিন্ন সময় দূরদর্শনে অনুষ্ঠান করেছি। তাই মহিষাসুরমর্দিনীই প্রথম কাজ নয় ওখানে
আমার।
মহিষাসুরমর্দিনী তাহলে কীভাবে?
সংযুক্তা: ১৯৯৪ সালে মহিষাসুরমর্দিনী যখন হয় তখন এর প্রোডিউসার ডিরেক্টর ছিলেন
শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্ত। সেই সময় কলামণ্ডলমে উনি এবং দূরদর্শনের আরও কয়েকজন এসেছিলেন
নতুন মুখ খুঁজতে। আমার গুরুদ্বয় পি গোবিন্দম কুট্টি ও থাঙ্কুমণি কুট্টি পরে আমাকে
জানিয়েছিলেন, ওনারা আগে দু’তিন বার এসেছিলেন কলামণ্ডলমে। কিন্তু দুর্গার জন্য
কাউকে পছন্দ হচ্ছিল না। তখন গুরুজি আমাদের কয়েকজনকে ডেকে পাঠান। সেই সূত্রেই আমি
নির্বাচিত হই।
পরবর্তী সময়ে
আর আপনাকে দুর্গা রূপে পাওয়া গেল না কেন?
সংযুক্তা: আমি ৯৪ থেকে একভাবে ২০০৪, পরবর্তীতে ২০০৭ পর্যন্ত মহিষাসুরমর্দিনী
করেছি। অন্যদেরকেও তো সুযোগ দিতে হবে (হাসি)।
বর্তমান মহালয়াতে
বিভিন্ন নামিদামী শিল্পী অভিনয় করছেন, কতখানি প্রাণ থাকে মনে হয় তাতে?
সংযুক্তা: (বেরিয়ে এল গভীর দীর্ঘশ্বাস) শোম্যানশিপটাই থাকে।
আপনি তো প্রবাসী,
সেখানে মহালয়া, দুর্গাপুজো নিয়ে কেমন উন্মাদনা দেখেন?
সংযুক্তা: কর্মসূত্র বা পড়াশোনা- বিভিন্ন কারণে বহু মানুষই তো আজ প্রবাসী। আমি
এখন টরন্টোতে আছি। কিছুদিন আগে থেকেই কিন্তু এখানে মহালয়ার রেশ শুরু হয়ে গিয়েছে।
আমেরিকাতে এই বিষয়টা ভীষণভাবে লক্ষ্য করা যায়। প্রবাসে প্রত্যেক সপ্তাহে অনেকগুলো
করে দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়। সপ্তাহান্তে একদম ভারতের তিথি মেনেই হয় সেই সব পুজো।
ধরো, যাঁরা ছোট ছোট অর্গানাইজার তাঁরা সপ্তাহান্তে পুজো করছেন। আর প্রত্যেকটি
পুজোয় মহালয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে বেতারে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চন্ডীপাঠ অনুসরণ করা
হয়। পুজোর পরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, তারপর জমিয়ে খাওয়া-দাওয়া।
প্রবাসে আপনার
নাচের স্কুলে বাঙালি আছে নিশ্চয়?
সংযুক্তা: আমার এখানে ড্যান্স অ্যাকাডেমি রয়েছে, তাতে চার থেকে চল্লিশ বছর বয়স
পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রী আছে। বাচ্চারা তো আছেই, বাচ্চার মায়েরা যারা দেশে থাকতে
বিভিন্ন জায়গায় নাচ শিখেছেন আজ পড়াশোনা, কাজের চাপে বন্ধ হয়ে গিয়েছে সে’সব, তাঁরাও
শিখছেন। আমি তাঁদের বলেছি নাচ চালিয়ে যাওয়ার কথা। আজ আমার শিশু ছাত্র-ছাত্রীদের
থেকে প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীদের সংখ্যাই বেশি। তাঁরা এক ঘণ্টা দেড় ঘণ্টা ড্রাইভ
করেও আমার কাছে আসেন নাচ শিখতে। এখানে তো আমার ডাক নাম হয়ে গিয়েছে দুর্গা।
বিদেশে আপনার
মহিষাসুরমর্দিনী কতখানি আলোচিত?
সংযুক্তা: বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে সবাই জানেন। আমি প্রতিটি জায়গাতে
গিয়েও টের পাই এই কথা। কিছুদিন আগে একটা অনুষ্ঠান করলাম রাধাকৃষ্ণের কোরিওগ্রাফির
উপরে। সেখানেও দেখেছি মহিষাসুরমর্দিনীর সূত্র ধরেই আমার অধিক পরিচিতি। সবাই ছবি
তুলতে চান কিন্তু দুর্গার সঙ্গেই। খুব ভাল লাগে এই ভেবে যে বিদেশে থেকেও বাঙালিরা
বাংলার রীতি রেওয়াজ মানছে। এখন তো এখানে বসে বাংলা চ্যানেলগুলো দেখা যায়। বরং
দূরদর্শনটাই কম পাওয়া যায়। তবে এখন ইউটিউব রয়েছে। আর জানো তো, এই জন্য আমি সারা
বছর মেসেজ পাই। সকলে যে বাঙালি তাও নয়। আসলে মহিষাসুরমর্দিনী ক্লাসিক্যাল ফর্মে
তৈরি হয়েছিল। সেই নাচটাকে দেখেই হয়তো যে কোনও মানুষ এখনও মেসেজ করেন।
কোথাও অনুষ্ঠান
করতে গিয়ে মহিষাসুরমর্দিনীর কিছু অংশ মঞ্চস্থ করে দেখানোর অনুরোধ এসেছে?
সংযুক্তা: একদম। অন্তত সাত-আটটা করে তো প্রতি বছর হয়, সেটা সোলো পারফরম্যান্সই
হোক বা গ্রুপ। এমনি ধরো, পুজোর প্রোগ্রাম ছাড়া কোনও অনুষ্ঠানে গিয়েছি, কিন্তু
মহিষাসুরমর্দিনীর কিছু অংশ করে দেখানোর অনুরোধ এসেছে। নিজের ঢাক নিজে পেটানো হবে
হয়তো, তাও একটা গল্প বলি। নিউইয়র্কের একটা অনুষ্ঠানে পুজোর সময় গিয়েছি। ওখানকার
একজন রিসার্চার, ভারত থেকে এদেশে এসেছেন। হঠাৎ দেখলাম আমাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম
করলেন। আমি তো প্রায় লাফিয়ে উঠেছি। ভীষন অস্বস্তি হচ্ছে। উনি দেখে বললেন, “আমি যে
এই অনুষ্ঠান সামনা সামনি দেখতে পাব ভাবিনি। আমি এসেছিলাম আপনারা আসছেন শুনে।”এই
শ্রদ্ধা, এই ভালবাসার সত্যিই কোনও তুলনা হয় না। আরও একটা ঘটনা আছে। একটি বাচ্চা
মেয়েকে তার বাবা-মা আমাকে দেখিয়ে কখনও বলেছিলেন আমিই দুর্গা। এবার পরে এই
ফ্যামিলিটি পুজোর সময় কোনও এক অনুষ্ঠান দেখতে এসছেন। সেদিন দুর্গার উপরেই ছিল গোটা
প্রোডাকশন। অনুষ্ঠান শেষে আমি দেখছি কে যেন আমার শাড়িটা ধরে টানছে। তাকিয়ে দেখি
চার-সাড়ে চার বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে। সে আমাকে খুব বকে বলল, ‘শোনো মা আর বাবা
বলেছে তুমি নাকি দুর্গা। দুর্গার তো তিনটে চোখ, দশটা হাত। তোমার তো সে’সব কিছুই
নেই। কোথায় গেল সে’গুলো?” আমরা তো হেসে খুন। বাচ্চাটির বাবা-মা মেয়েকে এই মারে কি
সেই মারে। আমি তখন বললাম, সত্যিই তো আমার তো সে’সব কিছুই নেই। ওর দুর্গা মোটেই আমি
নই।
সংসার জীবন, প্রবাস,
পেশা সব কিছুর বাইরে গিয়ে কলকাতাকে কতখানি মিস করেন?
সংযুক্তা: ভীষণ।
দেখো আমার তো আসল পরিবার কলকাতাতেই। খুব মিস করি। এখানে নিউ এডুকেশনাল ইয়ার শুরু
হয় সেপ্টেম্বরে। তাই পুজোর সময় ইচ্ছা থাকলেও আমরা গিয়ে উঠতে পারি না কলকাতায়। এটা
অত্যন্ত দুঃখজনক। কলকাতার রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা খাওয়া, গড়িয়াহাটে শপিং করা, সেই
ময়দানের বইমেলা ভীষণ ভীষনণ মিস করি। যদিও এখন আর ময়দানে বইমেলা হয় না।
মহিষাসুরমর্দিনীর
সময়ের কোনও অভিজ্ঞতা যা এত বছর পরেও স্মরণীয়?
সংযুক্তা: একটা
ঘটনা আমার চোখে আজও স্পষ্ট। সেটা ৯৭ বা ৯৮ সালের কথা। মনে আছে তখন দশ হাতের
সিকোয়েন্সটা হবে। সেই সময় দশভূজার সাজের জন্য কুমোরটুলি থেকে শিল্পীদের আনা হত।
ওনারা আমাকে দশভূজা করিয়ে ফ্লোরে নিয়ে যেতেন। মহিষাসুরমর্দিনী ছিল সরকারি
প্রযোজনা, তাই যখন তখন ছবি তোলার ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞা ছিল। আমরাও নিজেদের ছবি
তোলার সময় অনুমতি নিতাম। যাই হোক, এক ভদ্রলোক স্পেশাল পারমিশন নিয়ে এসেছিলেন ওই
শটটা দেখার জন্য। শটটা হয়ে যাওয়ার পরে আমরা যখন বেরিয়ে আসছি হঠাৎ তিনি আমার সঙ্গে
এসে কথা বলতে শুরু করলেন। উনি সম্ভবত চন্ডীর উপরে রিসার্চ করছিলেন। অনেকক্ষণ কথা
বলতে বলতে দেখলাম মন্ত্রচ্চারণ করতে করতে আমাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন ভদ্রলোক।
শেষে বলেছিলেন উনি আমাকে নন, প্রণাম করেছেন এই দশভূজার ফর্মটিকে। সেদিন বুঝেছিলাম
দর্শক হিসাবে এই ভাবনা মোটেই ভুল নয়। এই ঘটনা চিরস্মরণীয়।
আপনি তো সব খ্যাতনামা
ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে কাজ করেছেন মহিষাসুরমর্দিনীতে?
সংযুক্তা: সত্যি, আমি যাদের সঙ্গে কাজ করেছি সেটা অনেক বড় পাওনা। আমার প্রথম
স্ক্রিপ্ট রাইটার ছিলেন ডক্টর নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ি, তারপর অজয় ভট্টার্য, হীরেন
চট্টোপাধ্যায়। মিউজিকে পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী, হৈমন্তী শুক্লা, ইন্দ্রাণী সেন কে
ছিলেন না মহালয়ার অনুষ্ঠানে!
ভবিষ্যতে সুযোগ
পেলে আবার মহিষাসুরমর্দিনী করবেন?
সংযুক্তা: আজকের ডক্টর সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচয় কিন্তু
মহিষাসুরমর্দিনীর জন্যই। তাই ভবিষ্যতে সুযোগ এলে আমি আবার কাজ করব। বিভিন্ন
বেসরকারি চ্যানেল থেকে প্রস্তাব পেয়েছিলাম। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক তা
বাস্তবায়িত হয়নি। মুম্বই থেকেও এই দুর্গা প্রোডাকশনের উপরেই প্রস্তাব এসেছিল।
সেটাও হয়নি।
বাঙালির দুর্গাপুজোয়
বিদেশীরা ঠিক কতটা আনন্দ করেন?
সংযুক্তা: বাঙালি দুর্গাপুজোয় বিদেশিরা রীতিমতো ধুতি-পঞ্জাবী পরেন। আমি আমার
বরকে ধুতি পরাতে পারি না, ওরা কিন্তু পরেন। মহিলারা শাড়ি পরেন, নারী-পুরুষ
নির্বিশেষে হাত দিয়ে ভোগ খান। এটা নতুন কিছু নয়। এরকমও হয়েছে আমি দোকানে গিয়েছি
সালোয়ার কামিজ পরে। আমাকে দেখে এক বিদেশীনি জিজ্ঞাসা করছেন এমন সুন্দর ভারতীয়
পোশাক বিদেশে কোথায় কিনতে পাওয়া যায়। আমার ছেলের স্কুলে গেলেও শাড়ি পরতে হয়। সে
চায় তার মা দেশের ঐতিহ্যকে ধরে রাখুক।
অসংখ্য ধন্যবাদ।
খুব ভাল লাগল কথা বলে।
সংযুক্তা: (হেসে) ধন্যবাদ।